নৌপথে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়ছে।
নৌপথে পণ্য পরিবহনের ব্যয় বাড়ছে।

নৌপথে পণ্য পরিবহনে বাড়বে খরচ

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নারায়ণগঞ্জ নৌপথে প্রতি টন গম পরিবহনে আগে খরচ হতো ৬৬২ টাকা। লাইটার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ‘ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল’ থেকে জাহাজ বরাদ্দ নিলে এই ভাড়া দিতে হতো। গত বছরের ডিসেম্বরে সংস্থাটি ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমদানিকারকেরা দর–কষাকষি করে খোলাবাজার থেকে লাইটার জাহাজ ভাড়া নিচ্ছেন। তাতে একই পথে টনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা কমে ৫৪০ টাকায় নেমেছে। ভোগ্যপণ্য ছাড়া সিমেন্টের কাঁচামাল পরিবহনে এই খরচ সাশ্রয় হচ্ছে আরও বেশি—টনপ্রতি ১৫৪ টাকা।

তবে এখন কম খরচে পণ্য পরিবহনের সুযোগ আর থাকছে না। কারণ, ভেঙে যাওয়া পুরোনো সংস্থাটি আবার নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছে। এ জন্য গত ১৫ অক্টোবর নীতিমালা করেছে নৌপরিবহন অধিদপ্তর। নতুন নীতিমালায় পুরোনো সংস্থার নামের আগে বাংলাদেশ যুক্ত করে নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেল’। 

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্য পরিবহন কোনো সংগঠনের হাতে জিম্মি হতে পারে না। এটি প্রতিযোগিতা আইনের পরিপন্থী।
আমিরুল হক, এমডি, প্রিমিয়ার সিমেন্ট

নতুন নীতিমালায় জাহাজমালিকদের সংগঠনগুলো নিয়ে এই সেল গঠনের কথা বলা হয়েছে। তাদের ছাড়পত্র ছাড়া নদীপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেই বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। ভাড়াও দিতে হবে তাদের নির্ধারিত দর অনুযায়ী। দর–কষাকষি করার কোনো সুযোগ নেই। তবে কারখানার নিজস্ব নামে লাইটার জাহাজ থাকলে সেগুলোতে পণ্য পরিবহন করার সুযোগ রাখা হয়েছে।

আমদানিকারকেরা বলছেন, নতুন নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে শুধু গম নয়, নৌপথে ভোগ্যপণ্যের মতো শিল্পের কাঁচামাল, সারসহ সব পণ্য পরিবহনে খরচ বাড়তে পারে। সর্বশেষ ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বন্দরের বহির্নোঙরে আমদানি করা বড় জাহাজ থেকে ৭ কোটি ১৩ লাখ টন পণ্য লাইটার জাহাজে স্থানান্তর করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেওয়া হয়েছে। পণ্যভেদে ও দূরত্বভেদে ভাড়া কমবেশি হয়। নতুন নীতিমালা কার্যকর হলে তাতে টনপ্রতি গড়ে ১২০ টাকা বাড়তি খরচ ধরে আমদানিকারকদের হিসাবে বছরে পণ্য পরিবহন খরচ বাড়তে পারে ৮৫৫ কোটি টাকা। নিজস্ব জাহাজে যে পণ্য পরিবহন হবে, শুধু সেই পরিমাণ পণ্য পরিবহনে অর্থ সাশ্রয় হতে পারে।

ভাড়া আগের চেয়ে বেশি হবে না। ভাড়া এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে, যাতে জাহাজমালিক ও আমদানিকারকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়।
সাঈদ আহমেদ, সভাপতি, বিসিভোয়া

নতুন নীতিমালা নিয়ে প্রথম আলো দেশীয় ও বহুজাতিক ছয়টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনাকারীদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা বলছেন, পণ্য পরিবহনের জন্য আমরা চাইলে এখন খোলাবাজার থেকে প্রতিযোগিতামূলক দরে ট্রাক ভাড়া করতে পারি, বিশ্ববাজার থেকে বড় জাহাজ ভাড়া করতে পারি। তাহলে শুধু নদীপথে পণ্য পরিবহনের জন্য কেন নির্ধারিত সংস্থা থেকে ভাড়া নিতে হবে, যেখানে দর–কষাকষির সুযোগ থাকবে না।

জানতে চাইলে প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে পণ্য পরিবহন কোনো সংগঠনের হাতে জিম্মি হতে পারে না। এটি প্রতিযোগিতা আইনের পরিপন্থী। এতে শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্য পরিবহনে যেমন বাড়তি খরচ হবে, তেমনি দ্রুত পণ্য কারখানায় নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বড় জাহাজে করে যেসব পণ্য আমদানি হয়, তা ছোট জাহাজের মাধ্যমে নদীপথ ব্যবহার করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নেওয়া হয়। দুই দশক আগে জাহাজমালিকেরা ‘ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কো–অর্ডিনেশন সেল’ গঠন করে ক্রম অনুযায়ী আমদানিকারকদের জাহাজ বরাদ্দ দিত। তবে কয়েক বছর ধরে এই সংস্থার কর্মকর্তারা নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। আবার আমদানি বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী জাহাজ বরাদ্দও পাওয়া যেত না। তাতে বড় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে দেরি হওয়ায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ক্ষতিপূরণ গুনতে হতো আমদানিকারকদের।

আবার সাধারণ জাহাজমালিকদের জাহাজ বরাদ্দ না দিয়ে নেতাদের জাহাজ বেশি বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগও ছিল। অনিয়মের কারণে গত বছরের ডিসেম্বরে জাহাজমালিকদের তিন সংগঠনের দ্বন্দ্বে ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল ভেঙে যায়। এরপর নতুন নীতিমালা প্রণয়নের জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারকে চাপ দিতে থাকেন জাহাজমালিকদের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। তাঁদের চাপে নৌপরিবহন অধিদপ্তর নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করে। তবে সিমেন্ট প্রস্তুতকারক সমিতির নেতারা কয়েকটি সভা বয়কট করেন। আমদানিকারকদের আপত্তি সত্ত্বেও সরকারের পটপরিবর্তনের পর গত ১৫ অক্টোবর নীতিমালা প্রণয়ন করে নৌপরিবহন অধিদপ্তর।

নীতিমালা প্রণয়নের পর জাহাজমালিকদের তিন সংগঠনের একটি ‘বাংলাদেশ কার্গো ভেসেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন বা বিসিভোয়া’র নেতারা নৌপথে তদারকি শুরু করেছেন। এখনো জাহাজ বরাদ্দ কার্যক্রম শুরু না হলেও তাঁরা ছাড়পত্র ছাড়া জাহাজ চালানো যাবে না বলে জাহাজের মাস্টারদের জানিয়ে দিচ্ছেন। জানতে চাইলে বিসিভোয়ার নবনির্বাচিত সভাপতি সাঈদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আগে যেসব অনিয়মের কথা শোনা যেত, এখন সেগুলো হবে না। ভাড়া আগের মতোই থাকবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের চেয়ে বেশি হবে না। ভাড়া এমনভাবে নির্ধারণ করা হবে, যাতে জাহাজমালিক ও আমদানিকারকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, নৌপথে পণ্য পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। জাহাজমালিক ও আমদানিকারক—কোনো পক্ষই যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখেই এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।