আমের বাগানে ঝুলছে আম
আমের বাগানে ঝুলছে আম

আম রপ্তানি এবার অর্ধেকের কম, কারণ কী

গ্লোবাল ট্রেড লিংক নামের একটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গত বছর ছয়টি দেশে ৬০ টন আম রপ্তানি করেছিল। এর মধ্যে গত বছরের ঠিক এ সময়ে (জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে) প্রতিষ্ঠানটি ৩০ টন, অর্থাৎ অর্ধেক আম রপ্তানি করে ফেলেছিল। কিন্তু এবার এখন পর্যন্ত ১৫ টনের মতো রপ্তানি করা হয়েছে বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রাজিয়া সুলতানা।

শুধু রাজিয়ার প্রতিষ্ঠানেরই নয়, আম রপ্তানির করুণ দশা এবার প্রায় সব রপ্তানিকারকেরই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং সূত্র জানায়, মৌসুমের মাঝামাঝি সময়ের পরও এখন পর্যন্ত আম রপ্তানি যতটুকু হয়েছে, তা গত বছরের অর্ধেকের কম।

রপ্তানিকারক ও সরকারি সূত্র জানায়, উড়োজাহাজে জায়গার অভাব ও ভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে রপ্তানি অনেক কমেছে। বাইরের ক্রেতারা এত বেশি দামে আম কিনতে চাচ্ছেন না। আম রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় এবার বাংলাদেশের আমের দাম পড়ছে অনেক বেশি।

এদিকে সরকার এবার কৃষিপণ্যে প্রণোদনা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করেছে। এতে ভোগান্তি বাড়বে বলে মনে করেন রপ্তানিকারকেরা।

উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইং সূত্র অনুযায়ী, গত বছর বিশ্বের ৩৮টি দেশের ৩ হাজার ৯২ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ এবং আগের বছরের তুলনায় ৭৩ শতাংশ বেশি। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ২ হাজার ১২৩ টন আম রপ্তানি হয়েছিল।

উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের উপপরিচালক (রপ্তানি) মো. মফিজুল ইসলাম গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, এবার এখন পর্যন্ত ৬৭৭ দশমিক ৬ টন আম রপ্তানি হয়েছে। এটি গত বছরের এ সময়ের অর্ধেকের অনেক কম। এ বছর বাকি সময়ে গতবারের রপ্তানির কাছে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই মনে হচ্ছে।

রাজিয়া সুলতানা, স্বত্বাধিকারী, গ্লোবাল ট্রেড লিংক

উড়োজাহাজ ভাড়া দ্বিগুণের বেশি

গ্লোবাল ট্রেড লিংকের সূত্র জানায়, এবার প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে হিমসাগর, আম্রপালি, ল্যাংড়া ও হাঁড়িভাঙা আম পাঠিয়েছে। অথচ গত বছর এই তিন দেশ ছাড়াও পর্তুগাল, ডেনমার্ক ও ইতালিতে আম পাঠিয়েছিল। গত বছর কেজিপ্রতি খরচ হয়েছিল ২২০ টাকা, এবার হয়েছে ৫২০ টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির প্রধান রাজিয়া সুলতানা বলেন, ‘উড়োজাহাজের যে ভাড়া তাতে আমাদের আমের কেজি সাত ডলার রাখতে হচ্ছে। ভারতের আম সাড়ে পাঁচ ডলারে পাচ্ছেন ক্রেতারা। তাহলে ক্রেতারা আমাদের আমের নিতে আগ্রহী হবেন কেন?’

বাংলাদেশের আমের দাম বরাবরই ভারত বা পাকিস্তানের চেয়ে কিছু বেশি হয়। তারপরও বিদেশি ক্রেতারা স্বাদের জন্য বাংলাদেশের আম কিনতে চান। কিন্তু এবার যে দাম, তা আগের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে বলে জানান ফল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সানড্রে অ্যাপেটাইটের প্রধান নির্বাহী রেজাউল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ক্রেতারা রীতিমতো রাগারাগি করেছে, এটা স্বাভাবিক। কারণ, গত বছর যে আম পাঠাতে ২০০ থেকে ২৮০ টাকা লাগত, এবার তা আমি ৪৫০ থেকে ৫০৮ টাকায় দিয়েছি। ৩০ টাকার কাঁঠাল কিনে এর জন্য ভাড়া দিতে হয়েছে ৫০৮ টাকা।’

রেজাউল ইসলাম, প্রধান নির্বাহী, সানড্রে অ্যাপেটাইট

উড়োজাহাজে জায়গা পাওয়াও দুষ্কর

উড়োজাহাজের ভাড়ার পাশাপাশি এতে আম পাঠানোর জায়গা পাওয়া রপ্তানিকারকদের একটা বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন রপ্তানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, হাতে-পায়ে ধরে জায়গা পেতে হচ্ছে উড়োজাহাজে।

গত বছরও বাংলাদেশ বিমান, কাতার ও ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজে করে আম পাঠাতেন রপ্তানিকারকেরা। গত বছরের অক্টোবর থেকে ইত্তেহাদের ফ্লাইট পরিচালন বন্ধ রয়েছে। এতে রপ্তানির পরিসর কমেছে। তাঁদের বক্তব্য হলো, তৈরি পোশাককে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পচনশীল রপ্তানি পণ্যকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে যেসব বিদেশি সংস্থার উড়োজাহাজ চলাচল করে তাদের পচনযোগ্য পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট আলাদা জায়গা রাখার শর্ত দেওয়া উচিত বলে মনে করেন রপ্তানিকারকেরা। এটি সরকারকেই করতে হবে।

মোহাম্মদ আরিফুর রহমান, পরিচালক, রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প

আম রপ্তানিকারকেরা যুক্ত আছেন বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে। সংগঠনটির উপদেষ্টা মো. মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলছিলেন, বিদেশি উড়োজাহাজগুলোকে পচনশীল রপ্তানি পণ্যের জন্য নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দের শর্ত সরকারই আরোপ করতে পারে। এটা করা হলে এসব পণ্য নেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের বাধ্যবাধকতা থাকত।

উড়োজাহাজের এই সুবিধার পাশাপাশি রপ্তানিকারকেরা বাড়তি প্রণোদনা চান। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৪৩টি রপ্তানি পণ্যে নতুন করে প্রণোদনার হার নির্ধারণ করে দিয়েছে। এর মধ্যে ফলমুলসহ কৃষিপণ্যও আছে। প্রণোদনার নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ, যা গত ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১৫ শতাংশ।

প্রণোদনা কমিয়ে দেওয়া আম রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘উড়োজাহাজের ভাড়া আকাশচুম্বী হওয়ায় আমরা জাহাজে আম পাঠানোর পরিকল্পনা করছি। প্রথম চালান যাবে নেদারল্যান্ডসে। এটি কার্যকর হলে ভবিষ্যতে জাহাজকেই বেছে নেওয়া হবে।’