ভোক্তা অধিদপ্তরে সভা

উবার-পাঠাওয়ের ভাড়া ও কমিশন যৌক্তিক হতে হবে

শরিকি যাত্রা বা রাইড শেয়ারিংয়ের জন্য ২০১৭ সালে নীতিমালা হলেও সেটির ঠিকঠাক বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কখনো ভোক্তা, কখনো চালক প্রতারিত হচ্ছেন বলে প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়। অনেক সময় অ্যাপের মাধ্যমে না চালিয়ে নিজেরাই শরিকি যাত্রা পরিচালনা করেন অনেক চালক৷ এতে উবার ও পাঠাওয়ের মতো কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে ভোক্তা অধিকারের বিষয়টি সামনে এনে কোম্পানিগুলোর ভাড়া নির্ধারণ ও কমিশন যৌক্তিক হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

আজ মঙ্গলবার বিকেলে এক মতবিনিময় সভায় ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, শরিকি যাত্রার কোম্পানিগুলো ভাড়া নিজেদের মতো করে ঠিক করে থাকে। এ ভাড়া কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে এবং কোম্পানিগুলো কত শতাংশ কমিশন নিচ্ছে, তা ভোক্তারা জানতে পারেন না। বিষয়টি কিন্তু এখন আলোচনায় আসছে।

সফিকুজ্জামান আরও বলেন, ভাড়া নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে যে ঝামেলা হচ্ছে, সেটা চালক পোহাচ্ছেন। কোম্পানিগুলো সেটার দায় নিচ্ছে না। অভিযোগ এলেও তা আন্তরিকতার সঙ্গে নিষ্পত্তি করছে না।

কোম্পানিগুলোর উদ্দেশে এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘কোন কোম্পানি ভাড়ার কত শতাংশ তার প্রতিষ্ঠানের জন্য কমিশন হিসেবে রাখছে, তা স্পষ্ট হওয়ার জন্য আপনাদের তথ্যগুলো আমাদের জানাবেন। এখানে ভোক্তা অধিকারের বিষয় আছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চাই। চালক বা মালিক যাঁরা আছেন, তাঁদেরও রুটিরুজির ব্যাপার আছে।’

ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনে করেন, ‘একটি কোম্পানির হাতে ৫০ শতাংশের বেশি বাজার-শেয়ার চলে গেলে তখন সেটা মনোপলি হয়ে যায়। তখন সমস্যা তৈরি হয়। তবে অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কর্মশালা করব।’

ভাড়া যৌক্তিকভাবে নির্ধারণ হচ্ছে কি না, সেটা দেখার পাশাপাশি নীতিমালার সঠিক বাস্তবায়ন নিয়েও কাজ করার আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পাঠাওয়ের আইনি পরামর্শক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘সেবা দেওয়ার সঙ্গে কিছু সমস্যা থাকবেই এবং তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। তবে একটা কোম্পানিতেই শুধু গাড়ি চালাতে পারবে, অন্য কোম্পানিতে সেই গাড়ি নিবন্ধন নিতে পারবে না, এমনটা হতে পারে না। অভিযোগ নেওয়ার জন্য ৯৯৯ নম্বরে কল নেওয়ার সরাসরি সুযোগ রাখার জন্য পুলিশকে আমরা তিনবার চিঠি দিয়েছি। তবে তাঁরা এখনো প্রস্তুত নন।’

চালকদের জন্য পোশাক নির্দিষ্ট করার সমস্যা নিয়েও কথা বলেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, শরিকি যাত্রার কাজ করেন, এমন ৪০ শতাংশ চালক অন্য কোথাও কাজ করে থাকেন। তাই সামাজিক দৃষ্টিকোণের বিষয়টি বিবেচনা করে ইউনিফর্ম প্রবর্তনের মতো কাজেও হাত দেওয়া যাচ্ছে না। ভাড়াসহ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে পাঠাও সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উপপরিচালক সুব্রত কুমার বলেন, শরিকি যাত্রার নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করার সময় দেখা গেছে, ট্যাক্সি ক্যাবের অনেক নীতিগত বিষয় এর মধ্যে চলে এসেছে। সেবাটি দেওয়ার জন্য ১৮টি কোম্পানিকে অনুমোদন দেওয়া হলেও চালু আছে ১৫টি কোম্পানিতে।

মতবিনিময় সভায় সুব্রত কুমার জানান, উবারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বেশি পাওয়া যায়। ঢাকায় উবারে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ২৩ হাজার ৭০০। সিলেট ও চট্টগ্রামে তাদের ব্যবসা আছে। বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৩০ হাজার গাড়ি উবারে চলে। তিনি বলেন, চাইলে চালকেরা অন্য কোম্পানির অ্যাপ ব্যবহার করে গাড়ি চালাতে পারেন।

উবার বাংলাদেশের লিগ্যাল কাউন্সিলর সাদিকুল ইসলাম বলেন, ‘শরিকি যাত্রার নীতিমালাটি ট্যাক্সি ক্যাব নীতিমালার ভিত্তিতে করা হয়েছে। ট্যাক্সি ক্যাব সেবাটি চলত মিটারে। কিন্তু আমাদের এ সেবায় যেহেতু মিটারে চালানোর সুযোগ নেই, তাই চালকেরা কখন অনলাইনে থাকবেন আর কখন থাকবেন না, সেটি তাঁদের ইচ্ছার ব্যাপার। তবে আমাদের ভাড়া ট্যাক্সি ক্যাব গাইডলাইনের বাইরে যায় না।’

সাদিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় উবারের ২৩ হাজারের ওপরে গাড়ি থাকার পরও অভিযোগ অনেক কম। তিনি উল্লেখ করেন, নীতিমালায় বলা আছে যে আগে কোম্পানিতে অভিযোগ জানাতে হবে এবং এরপর সরকারি সংস্থায় অভিযোগ করা যাবে।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ঢাকায় মোটরসাইকেল চলছে পাঁচ লাখের মতো। সারা দেশের আরও ৮-১০ লাখ মোটরসাইকেল শরিকি যাত্রার মডেলে চলে। কমিশনের হার বেড়ে গেলে শেষ পর্যন্ত তা যাত্রীর ওপর এসে পড়ে। তাই কীভাবে ভাড়া ঠিক করা হচ্ছে, তার বিস্তারিত ওয়েবসাইটে প্রদর্শন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েক গাড়ি ও মোটরসাইকেলচালক। তাঁদের অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানান।

কমিশন নির্ধারণের পদ্ধতি জানা থাকা জরুরি, এমন দাবি জানিয়ে চালকদের অনেকে জানান, ভাড়ার কত শতাংশ কমিশন হিসেবে নেওয়া হচ্ছে, তা তাঁদের জানানো প্রয়োজন। তাঁরা অভিযোগ করেন, কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা বলে অনেক সময় সমস্যার প্রতিকার পাওয়া যায় না, বরং হুটহাট বহিষ্কার করা হয়। এমনটা হতে পারে না। এখানে তাঁদের বিনিয়োগ আছে। অনেক জায়গা-জমি বিক্রি করে এ সেবায় চালক হিসেবে এসেছেন।

ক্যাবের প্রতিনিধি ও ভোক্তাকণ্ঠ সম্পাদক আবদুল হান্নান বলেন, ‘ব্যক্তিগত গাড়ি উবারে দেওয়ার বিধান আরও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। আমার প্রস্তাব ব্যক্তিগত গাড়ি এক বছর চালানোর পর সেটি উবারে আসতে পারে।’

মতবিনিময় সভায় জানানো হয়, উবার একটি শরিকি যাত্রা থেকে ২৫ শতাংশ ও পাঠাও ১৫ শতাংশ কমিশন নিয়ে থাকে। কেবল ঢাকায় উবারে নিবন্ধিত গাড়ি আছে ২৩ হাজারের বেশি, আর ৬ হাজারের বেশি গাড়ি আছে পাঠাওয়ের। তবে অনেক চালক উবার, পাঠাও কিংবা ওভাইয়ের মতো শরিকি যাত্রার একাধিক কোম্পানিতে নিবন্ধন নিয়ে সেবা দিয়ে থাকেন।