বাজারে একটির দাম কমলে বাড়ে দুটির

বিশ্বব্যাংক বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, শ্রীলঙ্কায় মূল্যস্ফীতি কমলেও বাড়তি শুধু বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সীমিত আর স্বল্প আয়ের যেসব মানুষকে বাজারে যেতেই হয়, বলা যায় হিসাব মিলিয়ে পণ্য কিনতে তাঁদের বেশ কসরতই করতে হচ্ছে। কোনো এক পণ্যের সামান্য একটু দাম কমলে বাড়ে আরও দুটি পণ্যের। আর চাল, ডাল, ভোজ্যতেলসহ বেশির ভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সেই যে বেড়েছিল, সেখান থেকে আর নামেনি। বলা যায়, এসব পণ্যের দাম উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল রয়েছে।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো ব্যতিক্রম নয়। মূল্যস্ফীতির ছোবল হানেনি, এমন দেশ বিরল। কিন্তু বাংলাদেশ সেই দেশগুলোর একটি, যারা মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি। বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য একসময় সরকারিভাবে বিশ্ববাজারকে দায়ী করা হলেও ওই যুক্তি আর চলছে না। তাঁদের মতে, বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থার বড় রকমের দুর্বলতা রয়েছে এবং এটাই মূল সমস্যা।

বাজার পরিস্থিতি

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে খুচরায় পণ্য বিক্রির চারটি বাজারে গিয়েছিলেন প্রথম আলোর প্রতিবেদক। বাজারগুলো হচ্ছে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, মিরপুর-৬ নম্বর সেকশন, মহাখালী ও কারওয়ান বাজারের কাঁচাবাজার।

দেখা গেল, নিম্ন আয়ের মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়ে যে মাছ কেনেন, সেই পাঙাশ, রুই ও তেলাপিয়া মাছের দামও বাড়তি। আমদানির খুব একটা প্রভাব পড়েনি কাঁচা মরিচে। বিপরীতে গত সপ্তাহের তুলনায় ব্রয়লার মুরগি কেজিতে আরও ১০ টাকা বেড়েছে। সোনালিকা (কক) মুরগি কোনো বাজারে কেজিতে ৫-১০ টাকা বেশি দামে, আবার কোথাও আগের দামেই বিক্রি করতে দেখা গেছে। ফার্মের মুরগির ডিমের দামে পরিবর্তন নেই, প্রতি ডজন ১৪০ টাকা।

আমরা অতীতেও দেখেছি, বাংলাদেশে একবার জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আর কমে না। কারণ, এখানে বাজারব্যবস্থায় গলদ আছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান

গতকাল খুচরায় ছোট আকারের রুই মাছ প্রতি কেজি ২৭০-২৮০ টাকা, তেলাপিয়া ২৩০-২৪০ টাকা ও পাঙাশ মাছ ২২০-২৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। কৃষি মার্কেটের মাছ বিক্রেতা আতাউর হোসেন দাম বাড়ার জন্য মাছের খাবার ও পরিবহনের বাড়তি খরচকেই দায়ী করলেন। ঈদুল আজহার পর গরুর মাংসের বিক্রি কমেছে, কিন্তু দাম কমেনি। চার বাজার ঘুরে দেখা যায়, গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭৫০-৭৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

মহাখালী কাঁচাবাজারের চাঁদপুর ট্রেডার্সের চাল বিক্রেতা হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে জানান, নতুন বোরো চাল বাজারে আসার পর চালের দাম কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে। তবে কখনো কখনো চালের মানের তারতম্যের কারণে বস্তাপ্রতি (৫০ কেজির) ৫০-১০০ টাকা বেশি লাগে।

দানার আকারের ওপর ভিত্তি করে মসুর ডালের বিভিন্ন দাম ছিল। সয়াবিন তেল অবশ্য লিটারপ্রতি নির্ধারিত ১৭৯ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।

কিছুটা স্বস্তি দেখা গেছে সবজির বাজারে। বৃষ্টিপাত কম, তাই সবজির দামও খানিকটা কমেছে বলে জানান বিক্রেতারা। এক সপ্তাহ আগের তুলনায় সবজি ১৫-২০ টাকা কমে বিক্রি করতে দেখা গেছে। তবে আমদানির পরও খুব বেশি কমেনি কাঁচা মরিচের দাম, মানভেদে গতকাল বিক্রি হয়েছে ২৫০-২৮০ টাকায়।

শুধু এটুকু বলতে চাই, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।
মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা আফরিন ইসলাম

দাম বেড়েছে চীনা রসুনের। গত সপ্তাহে ছিল ১৮০ টাকা কেজি, গতকাল বিক্রি হয়েছে ২০০ টাকায়। তাল মিলিয়ে ২০ টাকা বেড়েছে দেশি রসুনের দাম, বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। এ ছাড়া আমদানি করা আদা ১৮০ টাকা, ভারতীয় পেঁয়াজ ৪৫ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকা এবং আলু ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনের বাসিন্দা আফরিন ইসলাম দ্রব্যমূল্য নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘শুধু এটুকু বলতে চাই, যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।’ তাঁর মতে, সংসার চালাতে কত কিছু যে ত্যাগ করতে হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে করা একটি প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংক চলতি সপ্তাহেই হালনাগাদ করেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপর তা ৮ শতাংশের ঘরে নেমে এলেও সম্প্রতি আবার তা বেড়েছে। গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭ শতাংশে উঠেছে।

প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কমেছে। শ্রীলঙ্কায় এখন তা কমে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। তবে পাকিস্তানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমলেও এখনো ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ, মিসর, জাপান, ভিয়েতনাম ও আর্জেন্টিনার খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার এখনো বাড়তি। নিম্নমুখী হতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, নেপাল, ভুটান, ব্রাজিল ও মালদ্বীপের সূচক।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজারে খাদ্যের দাম কমছে। বার্ষিক হিসাবের ভিত্তিতে ভুট্টা ও গমের দাম এক বছর আগের তুলনায় এখন ১৯ শতাংশ কম, তবে চালের দাম ১৬ শতাংশ বেশি।

কেন কমছে না বাংলাদেশে

বিশ্বব্যাংক চলতি সপ্তাহেই হালনাগাদ করেছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, ২০২২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এরপর তা ৮ শতাংশের ঘরে নেমে এলেও সম্প্রতি আবার তা বেড়েছে। গত জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭ শতাংশে উঠেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান দায়ী করেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারব্যবস্থার দুর্বলতাকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অতীতেও দেখেছি, বাংলাদেশে একবার জিনিসপত্রের দাম বাড়লে আর কমে না। কারণ, এখানে বাজারব্যবস্থায় গলদ আছে।’

সেলিম রায়হানের মতে, স্থানীয় উৎপাদন কিংবা আমদানি উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীরা ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত সরবরাহ চেইন নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি বলেন, সরকার যখন বলে যে বিশ্ববাজারের কারণে দাম বাড়ছে, তখন সেই ভাষ্য তাঁদের খুব সুবিধা দেয়।

সেলিম রায়হান আরও বলেন, মোদ্দাকথা হলো, এখানে জবাবদিহির ঘাটতি রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাজার ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি রয়েছে। যেমন ভারতে প্রতিযোগিতা কমিশন আছে। এখানে ব্যবসায়ীরা যেহেতু প্রভাবশালী কিংবা প্রভাবশালী বলয়ের সঙ্গে জড়িত, তাই তাঁরা পার পেয়ে যান।