হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের এক মাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো রক্তক্ষরণ চলছে ভারতের আদানি গোষ্ঠীর। প্রতিদিনই নিয়ম করে তাদের শেয়ারের দাম কমছে।
ভারতের বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৪ জানুয়ারি হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত ১০টি কোম্পানির বাজার মূলধন প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৫২ হাজার ৩৪৩ কোটি রুপি করে কমেছে। তাতে আদানি গোষ্ঠীর বাজার মূলধন গত ১ মাসে প্রায় ৬৩ শতাংশ বা ১২ লাখ ৫ হাজার কোটি রুপি কমেছে। তারা বলছে, বিশ্বের ইতিহাসে এত অল্প সময়ে আর কোনো কোম্পানির বাজার মূলধন এতটা কমেনি।
একই সময়ে গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য কমেছে। গত ২৪ জানুয়ারি ফোর্বস ম্যাগাজিনের ধনীদের তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল চতুর্থ আর আজ বিকেলে ছিল ৩৩ তম। সম্পদমূল্য ১১৯ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার বা ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৮১৩ কোটি রুপি থেকে ৩৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বা দুই লাখ ৯২ হাজার ৭২৭ কোটি রুপিতে নেমে এসেছে। অর্থাৎ তাঁর সম্পদ মূল্য কমেছে ৮ হাজার ৩৭০ কোটি ডলার ছয় লাখ ৯৪ হাজার ৮৬ কোটি রুপি ।
এই বাস্তবতায় আদানি গোষ্ঠীর বাজার মূলধন এখন ৭ লাখ ১৬ হাজার কোটি রুপিতে নেমে এসেছে। বাজার মূলধনের দিক থেকে ভারতের বাজারে তাদের অবস্থান এখন চতুর্থ, তাদের আগে আছে টাটা, রিলায়েন্স ও রাহুল বাজাজ গ্রুপ। অথচ হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশের আগে আদানি গোষ্ঠীর অবস্থান ছিল দ্বিতীয়।
আদানি গোষ্ঠীর এই নাটকীয় পতনের কারণে ভারতের শেয়ারবাজারের নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত বাজার মূলধন ২০ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন বা ২০ লাখ ৪০ হাজার কোটি রুপি কমে গেছে। ফলে বাজার মূলধনের দিক থেকে বিশ্বে ভারতের অবস্থান নিচে নেমে গেছে। আগে তারা পঞ্চম স্থানে থাকলেও এখন তাদের অবস্থান সপ্তম।
বলা বাহুল্য, আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারদর পতনের কারণে যেমন এই পতন হয়েছে, তেমনি তার প্রভাবে তালিকাভুক্ত অন্যান্য কোম্পানির বাজারদর কমেছে। এর সম্মিলিত প্রভাবে বৈশ্বিক পরিসরে ভারত পঞ্চম থেকে সপ্তম স্থানে নেমে গেছে।
ভারতের শেয়ারবাজারের অন্যতম সূচক নিফটি ৫০০। দেশটির শীর্ষস্থানীয় ৫০০টি কোম্পানির প্রতিনিধিত্ব করে এই সূচক। ২৪ জানুয়ারির পর এই সূচকের মান পড়েছে ৫ শতাংশ।
আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারদর পতনের কারণে ভারতের শেয়ারবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। প্রতিবেদন প্রকাশের পর গত ৩০ জানুয়ারি ভারতের লাইফ ইনস্যুরেন্স করপোরেশন (এলআইসি) এক বিবৃতিতে জানায়, আদানি গোষ্ঠীর যে শেয়ার তারা কিনেছে, তার বাজারমূল্য ৩০ হাজার ১২৭ কোটি রুপি, যা এখন ২৫ হাজার কোটি রুপিতে নেমে এসেছে। তবে এলআইসি এর মধ্যে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে, নাকি আরও কিনেছে, তা জানা যায়নি।
প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আদানি এন্টারপ্রাইজ ও আদানি পোর্টস অ্যান্ড এসইজেডের শেয়ারদর যথাক্রমে ৬২ ও ২৭ শতাংশ কমেছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে আধুনিক গোষ্ঠীর ১০টি কোম্পানিতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ারের পরিমাণ ছিল ১ থেকে ১১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল এসএসসিতে ১১ শতাংশ।
হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদনটিতে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মোদ্দা কথা হলো, কারচুপির মাধ্যমে ধনী হয়েছেন গৌতম আদানি। তাঁর মালিকানাধীন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দর বাড়িয়েছে। এভাবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
আদানি শুধু ভারতেই দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছেন, তা নয়। এই ঘটনার জেরে বিশ্ববাজারেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। সুইস ব্যাংক ক্রেডিট সুসি ও যুক্তরাষ্ট্রের সিটি গ্রুপ বেসরকারি ব্যাংকারদের জন্য প্রদেয় ঋণের বন্ধক হিসেবে আদানির বন্ড নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বাজারে আরও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ডাও জোনস সূচক থেকে ছিটকে গেছে আদানি গোষ্ঠী। তাদের ঋণমানও আতশ কাচের নিচে এসেছে।
ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে কিছু ঋণ আগেভাগে পরিশোধ করছে আদানি গোষ্ঠী। কিন্তু তাতেও শিকে ছিঁড়ছে না, প্রায় প্রতিদিনই শেয়ারদর কমছে তাদের।
তবে এত হারানোর মধ্যেও আদানি গোষ্ঠী ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেয়েছে। গত বছর এই বন্দর কেনার চুক্তি করে তারা। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কায় দুটি বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রে নির্মাণের ঠিকা পেয়েছে তারা। সেখানে ৪৪ কোটি ২০ লাখ ডলার বিনিয়োগ করবে আদানি গ্রিন এনার্জি।