কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা—এ তিনটি খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের দাবি
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনে জানুয়ারি-জুন সময়ে ১০%-এর বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে
সিন্ডিকেট না ভাঙলে মূল্যস্ফীতি কমবে না
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন তিনটি বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো হলো অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতি; ঝুঁকিপূর্ণ ক্রমবর্ধমান দায়দেনা পরিস্থিতি এবং শ্লথ অর্থনীতি।
এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম অর্থনীতির এই তিন চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আসন্ন বাজেটে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। গতকাল রোববার ‘নতুন সরকার, জাতীয় বাজেট ও জনমানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক আলোচনা সভার মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলা হয়।
রাজধানীর এক হোটেলে এই আলোচনা সভার আয়োজন করে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
অনুষ্ঠানে বাজেটে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে দেখা গেছে, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা—এ তিনটি খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি করেন তাঁরা। অন্যান্য অগ্রাধিকারগুলো হলো সামাজিক অন্তর্ভুক্তি, দক্ষতা উন্নয়ন, দ্রব্যমূল্য, কৃষি, নারীর ক্ষমতায়ন; স্বাস্থ্য, সুশাসন, অবকাঠামো, শিশু, গৃহায়ণ ও পুনর্বাসন, জলবায়ু পরিবর্তন। ২ হাজার ২৪৯ জন নারী-পুরুষের কাছে অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমে এই জরিপ করা হয়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বলা হয়, গত ১৩ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে আছে। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এভাবে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। হয়তো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের চেয়ে আয় বেশি কমছে।
সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতি সম্পর্কে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দায়দেনা পরিস্থিতি শুধু বিদেশি ঋণ দিয়ে দেখলে হবে না। বিদেশি ঋণের প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ ঋণ সরকারকে দেশি উৎস থেকে নিতে হয়েছে। ঋণ পরিশোধে আমরা ব্যর্থ হয়নি। সেই গর্বের জায়গায় চিড় ধরেছে। জ্বালানি খাত ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মুনাফার অর্থ পরিশোধ বাবদ প্রায় ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ করা যায়নি। টাকার অবমূল্যায়ন সরকারের ঋণ পরিশোধের বোঝা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বলছে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের হিসাবে প্রবৃদ্ধি কমে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমেছে। কোভিডের পর প্রবৃদ্ধি ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়ায় বাধা এসেছে।
চলতি অর্থবছরে সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করেছে। নাগরিক প্ল্যাটফর্ম মনে করে, এই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে বাকি ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১০ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।
বাজেট মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়। তাতে আট হাজারের বেশি ব্যবহারকারীর কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। যাঁরা মন্তব্য করেছেন, তাঁদের ৬৪ শতাংশ জানিয়েছেন, আগামী বাজেট থেকে তাঁদের কোনো প্রত্যাশা নেই। ৮৯ শতাংশ সিপিডির এই উদ্যোগকে ‘লাভ’ ও ‘লাইক’ দিয়ে সাধুবাদ জানিয়েছেন। আর ১১ শতাংশ ‘অ্যাংরি’ ও ‘হাহা’ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সাধুবাদ না জানানোর ভাব প্রকাশ করেছেন।
সিন্ডিকেট ও মূল্যস্ফীতি
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিরোধীদলীয় উপনেতা ও সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। তিনি বলেন, পাঁচ-ছয়জন আমদানিকারক ব্যবসায় সিন্ডিকেট করেন। সিন্ডিকেট যদি ভাঙতে না পারি, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারব না। এই সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। পণ্যের সরবরাহের ঘাটতির কারণে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে না। দোকানে কম জিনিস দেখেন? মূল্যস্ফীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ভুগছে পিছিয়ে পড়া মানুষ। তিনি আরও বলেন, ‘কোভিডের পর রিজার্ভের অর্থ কমতে শুরু করে। কিন্তু রাজস্ব আদায়, রপ্তানি আয় খুব বেশি কমে যায়নি। তাহলে বিদেশি মুদ্রা কোথায় যাচ্ছে? লোকজন বলে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে।’
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমানে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান বলেন, বাজেট বরাদ্দের খাতগুলো পুনর্বিন্যাস করা উচিত। অপচয় বন্ধ করার পরামর্শ দেন তিনি।
সংসদ সদস্য ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘সংসদ সদস্য হিসেবে আমি যা বলতে পারি না, সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম তা বলেছে। ফরিদপুরে এলাকায় গেলে প্রতিদিন ২০০-২৫০ জন লোক আমার কাছে আসেন। তাঁদের ৪০ শতাংশ চিকিৎসায় সহায়তা চান, ঢাকায় চিকিৎসার জন্য যেতে চান। অথচ ফরিদপুর শহরে দুটি হাসপাতাল আছে। সেখানে ৩৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। আমি ওই সব লোকদের যাতায়াত ভাড়া দিয়ে ঢাকায় পাঠাই। এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন লোককে বেতন দিয়ে রেখেছি ওই সব রোগীকে সহায়তার জন্য। আমি শুনেছি, ফরিদপুর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রোগী নেই। তিনজন লোককে ভাড়া করে রোগী সাজিয়ে রাখা হয়। এভাবেই তিনি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুরবস্থার কথা তুলে ধরেন।’
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, দিনের পর দিন সরকারি বিভিন্ন সংস্থার অনাপত্তিপত্র আসে না, তাই বেসরকারি সাহায্য সংস্থার বিদেশি তহবিল আটকে রাখা হয়। অথচ এসব অর্থ মানব সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়। তিনি স্কুলে মিড ডে মিল চালুর সুপারিশ করেন।
বাজেট বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, করদাতাদের অর্থ যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বক্তব্য দেন।