দেশের অর্থনীতির স্বার্থে তিনটি ক্ষেত্রে সংস্কার করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেছেন, কষ্টদায়ক হলেও সংস্কার করতে হবে। তাতে অর্থনীতিতে একধরনের ভারসাম্য আসবে।
মোস্তাফিজুর রহমান যেসব বিষয়ে সংস্কারের কথা বলেছেন, সেগুলো হচ্ছে—প্রথমত, ব্যাংক খাতে সুশাসন ও রাজস্ব আয় বাড়াতে নতুন ব্যাংক কোম্পানি ও আয়কর আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। এই দুই আইনের যথাযথভাবে বাস্তবায়নে কিছু মানুষ হয়তো চাপে পড়বেন। সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজনীতিবিদের সদিচ্ছা লাগবে।
দ্বিতীয়ত, ডলারের দাম বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। হয়তো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। ডলারের দামে বড় ধরনের সমন্বয় করলে পণ্য আমদানির ব্যয় বাড়বে। তখন আমদানি শুল্ক কমানোর মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। যদিও ডলারের দাম বাড়লে পণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতাসক্ষমতা বাড়বে। রপ্তানিকারকদের প্রণোদনা দিতে হবে না। ব্যাংক–মাধ্যমে প্রবাসী আয় আসার হারও বাড়বে। তৃতীয়ত, ব্যাংকঋণের সুদের হারও বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) আয়োজনে দেশের সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, ডলার–সংকট, মূল্যস্ফীতি, ভূরাজনীতি, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দেন। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংগঠনটির সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।
যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত নতুন শ্রমনীতির অধীনে নিষেধাজ্ঞা আসার শঙ্কা আছে কি না, জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাণিজ্যে কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে কি আসবে না; এলে কোন পদ্ধতিতে আসবে—সেটি অনুমান করা কঠিন। তবে আমরা দেখেছি, শ্রম অধিকার ও কর্মপরিবেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে। এমন প্রেক্ষাপটে বলতে চাই, আমাদের যেসব জায়গায় উন্নতি করার প্রয়োজন আছে, সেগুলো যেন আমরা করি। শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সেগুলো আমরা করতে পারি।
শ্রমিকেরা এক দিনে সবকিছু চাচ্ছেন না বলে মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তাঁদের পাশ কাটিয়ে কিংবা সঠিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সমস্যা বাড়ে। ফলে তাঁদের কথা শুনে সমস্যা সমাধানে একটি রূপকল্প (রোড ম্যাপ) প্রণয়ন করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র কী করবে না করবে তারা জানে। নিষেধাজ্ঞা দিতেও পারে। তবে আমরা যত শৈথিল্য দেখাব, তত নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দেশটির আকাঙ্ক্ষা বাড়বে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মৌসুম চলছে। সরকারদলীয় প্রার্থীদের অর্থসম্পদ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রার্থীদের হলফনামা দেখে বিস্মিত, চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। এত কম সময়ে তাঁরা এত টাকার মালিক হলেন কীভাবে, সেটি একটি প্রশ্ন। যদিও এক কোটি টাকার জমির দাম এক লাখ টাকা উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে হলফনামার থেকেও প্রকৃত সম্পত্তির পরিমাণ অনেক বেশি হবে।
সিপিডির এই সম্মানীয় ফেলো মনে করেন, রাজনৈতিক দলের উচিত তাঁদের প্রার্থীদের সম্পদের বিশ্লেষণ প্রকাশ করা। দুর্নীতি দমন কমিশনেরও (দুদক) কাজ করা দরকার যে প্রার্থীদের এই বিপুল পরিমাণ সম্পদ যৌক্তিক, অযৌক্তিক নাকি অনৈতিক।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাজনীতি আর অর্থনীতিকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। গণতান্ত্রিক দেশে ভালো রাজনীতি মানেই হলো ভালো অর্থনীতি। সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। রাজনীতিবিদেরা যদি সংস্কারের উদ্যোগ না নেন, তাহলে উদ্যোক্তাদের যেটুকু করা সম্ভব, তা–ও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশে যেটুকু অর্জন হয়েছে, তার পেছনে শ্রমিক ও উদ্যোক্তাদের পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের বড় অবদান রয়েছে। সামনের দিনে আরও অর্জন করতে পারলে তাঁদের অবদান থাকবে। না করতে পারলে তাঁদের বড় ধরনের ব্যর্থতা থাকবে।