দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে দুর্নীতির জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের অনিয়মের পাশাপাশি ব্যবসায়ী নেতাদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, নেতারা ব্যবসায়ীদের কাছে জবাবদিহি করার পরিবর্তে পদে এসে ক্ষমতাসীনদের অনুগত থাকেন। এর শুরুটা হয় নির্বাচনের মাধ্যমে বণিক সংগঠনের পদে না এসে মনোনয়নের মাধ্যমে এসে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ এই ফেলো আরও মনে করেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সার্বিক পরিবেশে দুর্নীতির প্রকোপ কমবে না। আজ রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত বেসরকারি খাত এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের দুর্নীতির সমস্যা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ও ‘কল টু অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যদি কোনো বণিক সংগঠনের নেতা বিনা ভোটে ক্ষমতা পান, তখন তিনি যাঁদের মদদে মনোনীত হয়েছেন, তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করে থাকেন। ব্যবসায়ীদের জন্য কাজ না করে তাঁদের প্রতি অনুগত থাকেন। এ জন্য ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে।
‘তত দিন পর্যন্ত অবস্থার কোনো পরিবর্তন আশা করতে পারি না, যত দিন না এসব প্রতিষ্ঠান একটি কাঠামোর মধ্যে জবাবদিহির আওতায় আসে’, যোগ করেন তিনি। এ জন্য অবশ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘দুর্নীতি বলতে আমরা সাধারণত সরকারি ব্যবস্থাপনায় জনগণের অর্থ অপচয়ের কথা বলে থাকি। তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, এনজিও কিংবা মিডিয়ায় যে দুর্নীতি নেই, তা বলা যাবে না। এসব ধরনের দুর্নীতি দারিদ্র্য সৃষ্টি করে, দক্ষতা নষ্ট করে, আস্থার সংকট বাড়ায় এবং বিনিয়োগের পরিবেশ ও সমাজকে শেষ করে দেয়।’
ডিজিটাল ব্যবস্থা চালুর পর সরকারের কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমলেও সরকারি ক্রয়ব্যবস্থায় এখনো অনিয়ম হয় বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি পরামর্শ দেন যে সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণমূলক না হয়ে সমর্থনমূলক হতে হবে।
অনুষ্ঠানে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, যে দেশে অন্যায় করে টাকা আয় করার পর সেই টাকা ভোগ করার সুযোগ থাকবে, সেখানে দুর্নীতি কমবে না। শক্তভাবে আইনের প্রয়োগ হচ্ছে না। যাঁর কাছেই দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তিনি পারছেন না। কাজেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে এমন আলোচনা আরও হতে হবে। তবে আলোচনা করে থেমে থাকলে হবে না, বরং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ব্যবসার সনদ নেওয়ার বিড়ম্বনা ছোট উদ্যোক্তাদের ছেড়ে কথা বলছে না। কারণ, যাঁরা এ সনদ দিয়ে থাকেন, তাঁরা সনদের সরকারি ফি ছাড়াও বাড়তি টাকা নেওয়ার মায়া ছাড়তে পারছেন না।
এসএমই ফাউন্ডেশনের কোনো সেবা পেতে এক টাকারও লেনদেন করতে হয় না, এ দাবি করে মফিজুর রহমান বলেন, এই ফাউন্ডেশনকে শক্তিশালী করার জন্য বারবার বলা হলেও তা করা হচ্ছে না। তবে আশা করছি, পরিবর্তন আসবে। এ উদ্যোগের মতো সবখানে কথা বলতে হবে এবং তাতে হয়তো পরিবর্তন দ্রুত আসবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য ভ্যাট-ট্যাক্স একটা ভয়ের কারণ। তাঁদের রীতিমতো ধমকানো হয়। বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এসে তাঁদের ধরবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ দেশের অর্থনীতিতে এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অনেক বেশি। তাদের বিপণনসহ নানা খাতে সুবিধা দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে।
বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক বলেন, ‘আমাদের এখানে যাঁরা পুঁজি নির্মাণ করছেন, তাঁদের চেতনার জায়গায় মরিচা ধরেছে। টাকা পাচারের ইতিহাস গড়া হয়েছে। আমাদের এখানে শিক্ষার মানের ঘাটতি আছে।’ তাঁর মতে, ক্ষুদ্র শিল্পের বিকাশের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল সংস্কার করতে হবে। তাইলে হয়তো মানুষের মুক্তি আসবে। অন্যথায় দুর্নীতির সঙ্গে বাঁচার কৌশল শিখতে হবে।
সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, লুটেরা যদি দেশ শাসন করেন, তাহলে দুর্নীতি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর মধ্যে থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দেশের আইনকাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছে, ফলে দুর্নীতি আরও বেড়ে যাচ্ছে। ভূমি আইনের সংস্কার হতে হবে। এতে দেশের বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠী কিছুটা হলেও দুর্নীতি থেকে রেহাই পাবে।
আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান বলেন, মিডিয়ারও প্রায় সবখানেই দুর্নীতি বিরাজ করছে। পত্রিকা প্রকাশের সংখ্যা নিয়ে একটা তালিকা দেওয়া হয়। সেখানে অসত্য তথ্য প্রকাশ করা হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে এটার পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হচ্ছে। এখানে এত বেশি অনিয়ম যে সেটা বলার নয়। আগে মিডিয়ার দুর্নীতি নিয়ে কথা হওয়া উচিত।
নাইমুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘ফেসবুকে দেখেন সাংবাদিকদের জীবন এখন কেমন। একজন সাংবাদিক কত টাকা বেতন পান, আর তাঁর জীবন কী!’ সাংবাদিকেরা দেশের বাইরে যেতে এত টাকা কোথায় পান, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা উচিত। এটা যে রাজনীতির প্রধান একটি অ্যাজেন্ডা, সেটাই আমরা ভাবতে পারছি না।’ তিনি অভিযোগ করেন, বড় বণিক সমিতিগুলো ছোটদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে।
দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, এমন মন্তব্য করে রুহিন হোসেন বণিক সংগঠনগুলোতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অসৎ ব্যবসায়ী, অসৎ আমলা ও অসৎ রাজনীতিবিদ—এই তিনের সিন্ডিকেট না ভেঙে দিতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
দোকান মালিক সমিতির মহাসচিব জহিরুল হক ভূঁইয়া বলেন, ‘আগে সরকারি সেবা নিতে গেলে ঘুষ আড়ালে নেওয়া হতো, কিন্তু এখন ঘোষণা দিয়ে নেওয়া হয়। কোনো সংস্থার কাছে প্রতিবাদ করা হলে টুঁটি আরও চেপে ধরা হয়। তখন আর প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা থাকে না। ছোট ব্যবসায়ী হওয়ায় বেশি দূর যেতে পারি না। সরকারি বিভিন্ন সংস্থায় গিয়ে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয়।’
অ্যাসোসিয়েশন অব ফ্যাশন ডিজাইনারস অব বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানতাশা আহমেদ বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের আলাদাভাবে সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁরা যেন হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করতে হবে।
ব্রাইডাল ক্রিয়েশনের স্বত্বাধিকারী আবিদা সুলতানা বলেন, ছোট ছোট দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। আর ছোট ব্যবসায়ীরা অনলাইনে যে নানা প্রতারণার শিকার হন, সেগুলো বন্ধ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিজিএসের গবেষণা সহযোগী আবদুল্লাহ আল জাফরী। তিনি বলেন, দেশের এসএমই খাতের ব্যবসায়ীরা ব্যবসার সনদ নেওয়া থেকে শুরু করে ব্যাংকে ঋণ নিতে গেলেও অনেক ক্ষেত্রে ঘুষ দিতে হয়। এ ছাড়া সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে কর ফাঁকি দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বলে প্রবন্ধে উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।