বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর কারণ, দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো এক সপ্তাহ ধরে সরবরাহকারীদের (ডিলার) কাছে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।
ভোজ্যতেলের সরবরাহ বাড়াতে গতকাল বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। বৈঠকে ভোজ্যতেল আমদানিতে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়াতে রাজি হয়েছে কোম্পানিগুলো।
গতকাল রাজধানীর শেওড়াপাড়া, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, কাঁঠালবাগান ও নিউমার্কেট কাঁচাবাজার ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। বাজারগুলোর অধিকাংশ দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন কম ছিল। কাঁঠালবাগান বাজারের বিক্রেতা মাসুদুর রহমান বলেন, পাঁচ দিন ধরে দোকানে কোনো সয়াবিন তেল আসেনি। কবে নাগাদ তেল আসবে, তা–ও ডিলাররা জানাতে পারছেন না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে ১৭০ থেকে ১৭২ টাকা। আর পাম তেলের লিটারপ্রতি দাম ১৬২-১৬৩ টাকা। সেখানে বাজারে বোতলজাত এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৬৫-১৬৭ টাকা। গত এক মাসের ব্যবধানে খোলা সয়াবিনের দাম ১১ শতাংশ ও পাম তেলের দাম সাড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। মূলত আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় দেশেও পণ্যটির দাম বেড়েছে।
খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতারা জানান, বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের দাম অনেক বেড়েছে। এতে চাহিদা বেড়েছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের; কিন্তু বোতলজাতের চেয়ে খোলা সয়াবিন তেলের দাম বেশি হওয়ায় সরবরাহ বন্ধ রেখেছে পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো। তারা এখন বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়াতে চায়।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ডিলার মো. হাসনাইন বলেন, ‘মিলগেট থেকে সয়াবিন (বোতলজাত) তেল কেনার জন্য আমরা টাকা দিতে চাইলেও কোম্পানির লোকেরা টাকা নিচ্ছেন না, তেলও দিচ্ছেন না। ৮-১০ দিন ধরেই এ অবস্থা চলছে। গত পরশু বাজারে শুধু একটি কোম্পানির কিছু বোতলজাত তেল ঢুকেছে। আর কোনো কোম্পানির তেল বাজারে আসছে না।’
এদিকে গতকাল বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন সচিবালয়ে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। বৈঠকে বাণিজ্যসচিব মোহা. সেলিম উদ্দিন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান মইনুল খান, এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এবং সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ ও এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের সার্বিক দিক তুলে ধরে বিটিটিসি। ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কথা বলে দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধির দাবি জানান। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সয়াবিন ও পাম তেল আমদানিতে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হার ১০ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও এক মাস আগেই (গত ১৭ অক্টোবর) মূসক হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছিল। গতকাল মূসক কমানোর সিদ্ধান্তের পরে উৎপাদকেরা বোতলজাত তেলের সরবরাহ বাড়াতে রাজি হয়েছেন।
এ বিষয়ে ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী একটি কোম্পানির কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম প্রায় ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। ফলে সরকার মূসক পুরোপুরি প্রত্যাহার করলেও উৎপাদকেরা বাজার অনুসারে মূল্য সমন্বয় করতে পারছেন না। তার পরও তাঁরা সরকারকে সহযোগিতা করতে বাজারে তেলের সরবরাহ বাড়াবেন।
বাজারে এখন বাড়তি রয়েছে পেঁয়াজ ও আলুর দাম। তিন দিন আগেই পণ্য দুটির দাম বেড়েছিল। গতকাল প্রতি কেজি আলু ৭০-৭৫ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ১৪০-১৫০ টাকা ও আমদানি করা ভারতীয় পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বাজারে স্বল্প পরিমাণে নতুন (আগাম) আলু আসতে শুরু করেছে। এ আলুর কেজি ১২০-১৪০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, হিমাগারে আলু ও কৃষকের কাছে থাকা পেঁয়াজের সংগ্রহ শেষের দিকে। বাজারে নতুন আলু ও মুড়িকাটা পেঁয়াজ আসতে দেরি হচ্ছে। এ কারণে পণ্য দুটির দাম বাড়তি রয়েছে।
বাজারে শিম, ফুলকপি ও মুলার মতো শীতের কিছু সবজির সরবরাহ বেড়েছে। এতে পণ্যগুলোর দাম আরও কমেছে। যেমন দুই সপ্তাহের ব্যবধানে শিমের কেজি ২৩০-২৪০ টাকা থেকে কমে ১০০-১২০ টাকা হয়েছে। এভাবে ফুলকপি ও মুলার দাম কমে ৫০-৬০ টাকা হয়েছে। তবে সবজির মধ্যে পেঁপে কেজিতে ৫-১০ টাকার মতো বেড়েছে। গতকাল প্রতি কেজি পেঁপে ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অন্যদিকে বাজারে কাঁকরোলের মতো সবজির সরবরাহ কমেছে। গতকাল চারটি কাঁচাবাজার ঘুরে একটি স্থানেও কাঁকরোল বিক্রি হতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া বাজারে অন্যান্য শাকসবজির দাম আগের মতোই স্থিতিশীল রয়েছে।