আগে থেকেই সবজির বাজার চড়া, তাই মানুষ শাকের দিকে ঝুঁকছিল। এখন শাকও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে।
রাজধানীর মগবাজার রেললাইনের পাশের এক কলোনিতে থাকেন জোছনা বেগম। সেখানেই ভ্রাম্যমাণ ভ্যান থেকে এক আঁটি লাউশাক কিনে চল্লিশোর্ধ্ব এই গৃহিণী বেশ অসন্তোষই প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘২৫ থেকে ৩০ টাকার শাকের আঁটি এখন ৫০ টাকায় কিনলাম। তা-ও অনেক কথা খরচ করতে হলো। আগে এক আঁটিতে ৫টা লতা থাকত, এখন হয়েছে ৪টা।’
এক মাস ধরেই সবজির বাজার বেশ চড়া। শতকের ঘরও ছাড়িয়েছে বেশ কয়েকটি সবজির কেজি। তাই নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ ঝুঁকেছিল নানা ধরনের শাকপাতার দিকে। কিন্তু শাকেরও সরবরাহ-সংকট। ফলে আঁটি ছোট হয়েছে, দামও বেড়েছে সব ধরনের শাকের।
রাজধানীর শাহজাহানপুর, মালিবাগ ও মগবাজার ঘুরে এবং সবজি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক আঁটি লাউ ও কুমড়াশাকের দাম পড়ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, ডাঁটাশাক ৩০ থেকে ৪০ টাকা ও এক আঁটি পুঁইশাকের দাম রাখা হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এই চার ধরনের শাকের দাম গত এক মাসের ব্যবধানে ১০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কচুশাক বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা আঁটি। বেশ কয়েক পদের শাকের দাম গত এক মাসে দ্বিগুণ হয়েছে।
কিছুটা কম দামে যেসব শাক পাওয়া যেত, সেগুলোর দামও বেড়েছে আঁটিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা। পাটশাকের দাম এখন ২০ থেকে ২৫ টাকা আঁটি। বাজারে লালশাক ২৫ থেকে ৩০ টাকা, পালং ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, কলমিশাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, শর্ষেশাক ২০ থেকে ২৫ টাকা, মুলাশাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, আর হেলেঞ্চা শাক ১০ থেকে ২০ টাকা আঁটি বিক্রি হচ্ছে। কচুশাক বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা আঁটি। বেশ কয়েক পদের শাকের দাম গত এক মাসে দ্বিগুণ হয়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) লালশাক ও পুঁইশাকের বাজারদরের হিসাব রাখে। বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানের হিসাবে দুই বছর আগে লালশাক ও পুঁইশাকের কেজি ছিল ৪২ টাকা ৮ পয়সা। বাজারে সাধারণত কেজি হিসাবে শাক বিক্রি হতে দেখা না গেলেও বিক্রেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতি কেজিতে পুঁইশাকের দুই আঁটি ও লালশাকের চার আঁটির মতো হয়ে থাকে। আঁটির দামে হিসাব করলে এই দুই ধরনের শাকের দাম দুই বছরে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
বাজারে এর বাইরে বথুয়াশাক, তেলাকচু শাক ও থানকুনি পাতার মতো আরও কয়েক জাতের শাক বিক্রি হয়। এগুলো মূলত মৌসুমি শাক এবং সব সময় বাজারে পাওয়া যায় না। সরবরাহের ওপর এসব শাকের দাম নির্ভর করে।
শাকের দোকানে বিলাতি ধনেপাতা, শাপলার নালি, দেশি ধনেপাতা ও পুদিনা পাতার মতো শাকজাতীয় পণ্যও বিক্রি হয়। এর মধ্যে ধনেপাতার ছোট একটি আঁটি কিনতে খরচ পড়ে ১০ থেকে ২০ টাকা। আকারভেদে পুদিনাপাতার একটি আঁটির দাম ২০ থেকে ৫০ টাকাও হয়ে থাকে।
সবশেষ টানা যে বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে আমার লাখ টাকার সবজি নষ্ট হয়েছে। নতুন করে আবার শাকসবজি লাগিয়েছি। এসব সবজি বাজারে ওঠাতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবেধামরাইয়ের ফোর্ডনগর এলাকার সবজিচাষি ইয়াদ আলী
শাকের দাম কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হওয়ার কারণ হিসেবে বিক্রেতারা দায়ী করেন সরবরাহের ঘাটতিকে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক মাসের মধ্যে এক দফা ভারী বৃষ্টির ফলে ঢাকার বাজারে শাকের সরবরাহ ৩০ শতাংশের মতো কমেছে। ঢাকার বাজারে অধিকাংশ শাক সাভার, গাজীপুর, কেরানীগঞ্জ, নরসিংদী ও মুন্সিগঞ্জের মতো আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে আসে। শাকের খেত নষ্ট হওয়ার কারণে শাকের সরবরাহ কমেছে, বেড়েছে দাম।
ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ের ফোর্ডনগর এলাকার সবজিচাষি ইয়াদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবশেষ টানা যে বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে আমার লাখ টাকার সবজি নষ্ট হয়েছে। নতুন করে আবার শাকসবজি লাগিয়েছি। এসব সবজি বাজারে ওঠাতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে।’
বিক্রেতাদের কাছেও পাওয়া গেল একই রকমের তথ্য। মালিবাগের শাক বিক্রেতা মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে শাকসবজি কম আসছে। তাতে সবজির সঙ্গে সঙ্গে শাকেরও দাম বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে এখন মানুষ সবজির বাজারেও আসা কমিয়েছে।
শাকসবজি কম খেলে স্বল্প মেয়াদে শারীরিক দুর্বলতার মতো অসুবিধা, আর দীর্ঘ মেয়াদে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ দেখা দিতে পারে।ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতালের উপপ্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ফারজানা আনজিন
মাছ, মাংস ও ডিমের মতো প্রাণিজ আমিষের বাজার আগে থেকেই চড়া। চাল, ডাল ও ভোজ্যতেলের মতো অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে রয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে সাধারণ মানুষ কাটছাঁট করে সংসার চালাচ্ছেন। তাই শাকসবজির মতো পুষ্টির উৎসও সংকুচিত হয়ে এলে তা জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতালের উপপ্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা ফারজানা আনজিন প্রথম আলোকে বলেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে মাছ-মাংস কম খেয়ে মানুষের মধ্যে ভাত ও আটার মতো খাবার খেয়ে পেট ভরানোর প্রবণতা বেড়েছে। তাতে পেট ভরে, কিন্তু পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। বিভিন্ন ব্যাধির বিরুদ্ধে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে আসে। শাকসবজি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু এগুলো কম খেলে তার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনের প্রভাব থাকে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ফারজানা আনজিন বলেন, শাকসবজি কম খেলে স্বল্প মেয়াদে শারীরিক দুর্বলতার মতো অসুবিধা, আর দীর্ঘ মেয়াদে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ দেখা দিতে পারে।
আগে যে মৌসুমের শাক সেই মৌসুমে পাওয়া যেত। কয়েক বছর ধরে এখন সব ধরনের শাকই সারা বছর কমবেশি বাজারে আসে। দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকও বছরজুড়ে শাক চাষাবাদে আগ্রহ দেখায়বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার
বেশির ভাগ শাক একসময় গ্রাম পর্যায়ে প্রায় বিনা চেষ্টায় উৎপাদিত হতো। কিন্তু এখন শাকের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে, ফলে অধিকাংশ শাক সারা বছর ধরেই কমবেশি পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞ ও বাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে শতাধিক জাতের শাক পাওয়া যায়। গ্রামে সব ধরনের শাক দেখা গেলেও ঢাকার বাজারে সচরাচর ১৫ থেকে ২০ জাতের শাক পাওয়া যায়।
একসময় পালং, শর্ষে, মুলা, লালশাকের মতো শাক শুধু শীতকালে পাওয়া গেলেও বাণিজ্যিক চাষাবাদের কল্যাণে এসব শাক এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। আগে গ্রামের পুকুর, ডোবা ও বিলে কলমি এবং হেলেঞ্চার মতো যেসব শাক পাওয়া যেত, তারও এখন বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে এবং এসব শাক শহরের মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে যে মৌসুমের শাক সেই মৌসুমে পাওয়া যেত। কয়েক বছর ধরে এখন সব ধরনের শাকই সারা বছর কমবেশি বাজারে আসে। দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকও বছরজুড়ে শাক চাষাবাদে আগ্রহ দেখায়।’
তবে দেশে প্রতিবছর ঠিক কী পরিমাণ শাকের উৎপাদন হয়, সে ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট প্যাথলজি বিভাগের চেয়ারম্যান আবু নোমান ফারুক আহমেদ জানান, সবজির তুলনায় শাকের জাত উন্নয়ন ও দেশীয় জাত সুরক্ষায় গবেষণা কম হয়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তবে হরমোন ব্যবস্থাপনা সহজ ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট প্রয়োগের ফলে এখন সারা বছর শাকের উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এর কৃতিত্ব অগ্রসর কৃষককে দিতে হবে। তাঁরাই নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সারা বছর শাক উৎপাদন করছেন।