বাণিজ্য নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পরিকল্পনা করছেন, এর সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় ১০০ বছর আগের শুল্ক–সংক্রান্ত এক মার্কিন আইনের। স্মুট-হলি ট্যারিফ নামে পরিচিত ওই আইন ১৯৩০-এর দশকের অর্থনৈতিক মহামন্দাকে আরও গভীর করেছিল বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। ট্রাম্পের শুল্কনীতি একই পরিণতি ডেকে আনে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে।
ট্রাম্পের মতো অনেকটা একই রকম যুক্তি দিয়ে ১৯৩০ সালে প্রণয়ন করা হয়েছিল স্মুট-হলি ট্যারিফ আইন। বলা হয়েছিল, প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে, ফলে বিদেশি প্রতিযোগিতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষক ও কিছু শিল্পকে রক্ষার জন্য অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রে ফর্ডনি-ম্যাকক্যাম্বার আইনের কল্যাণে এর আগে থেকেই উঁচু শুল্ক বহাল ছিল।
ইউটাহর রিপাবলিকান সিনেটর রিড ওয়েন স্মুট ও অরেগন থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য, আরেক রিপাবলিকান উইলিস চ্যাটম্যান হলি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের আইনের মূল প্রবক্তা। ১৯২৯ সালে আইনটি পাসের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কিন্তু ওই বছরই শেয়ারবাজারে ধস নামার পর সুরক্ষাবাদ ও প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে পরের বছর বিলটি সিনেটে অল্প ভোটের ব্যবধানে পাস হয়। কিন্তু প্রতিনিধি পরিষদে এটি তেমন কোনো বাধার মুখেই পড়েনি।
আইনটির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন প্রেসিডেন্ট হারবার্ট হুভার। এক হাজারের বেশি অর্থনীতিবিদ তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন এটিতে স্বাক্ষর না করতে। প্রতিরোধ এসেছিল বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছ থেকেও। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হুভার শেষ পর্যন্ত জুনের ১৭ তারিখে এটিতে সই করেন, ফলে স্মুট-হলি ট্যারিফ বিল আইনে পরিণত হয়।
এই আইনের বলে অনেক পণ্যে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা ছিল। কোনো ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলে কৃষির মতো কিছু পণ্য বিদেশি পণ্যের প্রতিযোগিতা থেকে বড় ধরনের সুরক্ষা পায়। কিন্তু শুল্কের এই দেয়াল আখেরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো কোনো ফল বয়ে আনেনি।
মার্কিন শুল্ক আরোপের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইউরোপের দেশগুলো। এসব দেশ প্রথম মহাযুদ্ধের ক্ষত থেকে নিজেদের সারিয়ে তোলার চেষ্টায় ছিল। তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ছিল তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন জার্মানি। দেশটি একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশকে যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ পরিশোধ করছিল, আবার অন্যদিকে শুল্ক আরোপের কারণে বাণিজ্য করে সেই অর্থের সংস্থান করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। ইউরোপের এসব দেশ ইতিমধ্যেই মন্দার কবলে ছিল।
ফলে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ আসতে সময় নেয়নি। প্রায় ২৫টির মতো দেশ মার্কিন পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। এর পরিণতি হয় মারাত্মক। বৈশ্বিক বাণিজ্য ভয়াবহ পরিমাণ কমে যায়। ১৯২৯ সালের তুলনায় ১৯৩৪ সালে বিশ্ববাণিজ্যের পতন হয় ৬৬ শতাংশ। যদিও এই আইনের কল্যাণে যুক্তরাষ্ট্র শুরুর দিকে ইতিবাচক ফল পেয়েছিল।
তবে দ্রুতই স্মুট-হলি ট্যারিফের নেতিবাচক ফল পেতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯২৯ সালে দেশটির আমদানি ছিল ৪৪০ কোটি ডলারের, যা ১৯৩৩ সালে কমে আসে ১৫০ কোটি ডলারে। রপ্তানির ধস ছিল ৬১ শতাংশ। এই সময়ে রপ্তানি ৫৪০ কোটি ডলার থেকে নামে ২১০ কোটি ডলারে। ইউরোপ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ও রপ্তানি উভয়ই ব্যাপকভাবে কমে যায়।
বাণিজ্যের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেও খারাপ অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। স্মুট-হলি আইন পাসের সময় দেশটিতে বেকারের হার ছিল ৮ শতাংশ। এই আইনের লক্ষ্যই ছিল মানুষের কাজকে সুরক্ষা দেওয়া, আরও বেশি কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে বেকারত্বের হার কমানো। কিন্তু বাস্তবে উল্টোটিই ঘটে। ১৯৩১ সালে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ শতাংশে এবং ১৯৩২-৩৩ সালে ২৫ শতাংশে।
শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র উঁচু শুল্কের এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসে। ১৯৩২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট পরাজিত করেন হারবার্ট হুভারকে। রিড ওয়েন স্মুট ও উইলিস চ্যাটম্যান হলি দুজনই তাঁদের আসন হারান। আর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই শুল্ক কমানোর জন্য পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেন নতুন ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট।
১৯৩৪ সালে কংগ্রেস রেসিপ্রোক্যাল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টস অ্যাক্ট বা পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তি আইন পাস করে। এই আইনের বলে শুল্ক নীতি চলে যায় হোয়াইট হাউসের কাছে অর্থাৎ শুল্ক আরোপের দায়িত্ব পান প্রেসিডেন্ট। বিদেশি সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দর–কষাকষি করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট দুই তরফেই শুল্ক নির্ধারণের কর্তৃত্ব পান।
সেই কাজটিই এখন করতে চলেছেন দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচনে জয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রচারণার সময়ই তিনি ঘোষণা করেছেন, মার্কিন শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সুরক্ষার জন্য তিনি অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করবেন। সাধারণভাবে এর হার হবে ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত। তবে চীনের ক্ষেত্রে তিনি কমপক্ষে ৬০ শতাংশ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করবেন।
এখনকার তুলনায় ১৯৩০-এর দশকে বৈশ্বিক বাণিজ্য ছিল বেশ কম। ব্লুমবার্গের এক ব্যবসা মডেলে দেখা গেছে, ট্রাম্পের শুল্কের পরিণতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি ৫০ শতাংশ কমবে। আর চীন থেকে আমদানি কমবে ৯০ শতাংশের মতো অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাস্তবে তেমন কোনো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যই আর অবশিষ্ট থাকবে না।
অন্যদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যদি প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ না-ও করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমবে প্রায় ৪০ শতাংশ। এর কারণে হিসেবে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি অনেকাংশে নির্ভর করে বিদেশ থেকে সস্তায় কাঁচামাল আমদানির ওপর। সস্তায় কাঁচামাল না পেলে মার্কিন রপ্তানি কমে যাবে। আর যদি বাকি বিশ্ব প্রতিশোধমূলক শুল্ক আরোপ করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি কমবে ৬০ শতাংশ।
বাণিজ্যের যে বিশ্বায়ন শুরু হয়েছিল, ট্রাম্প ট্যারিফের কারণে তার পরিণতি কী হবে, তা এখনো অজানা। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, বাকি বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য করার নতুন বাস্তবতায় প্রবেশ করতে পারে। তবে ট্রাম্পের অনিশ্চিত আচরণের কথা সবাই জানেন। সুতরাং তিনি শেষ পর্যন্ত কী করবেন, সেটাই এখনো অনিশ্চিত।