ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের একজন গৃহকর্মীর নামেই মিলেছে কোটি টাকা। এই গৃহকর্মীর নাম মর্জিনা আকতার। তিনি চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত এই ব্যবসায়ীর বাসায় কাজ করতেন। মর্জিনা আকতারের নামেই ব্যাংকে এক কোটি টাকার স্থায়ী আমানতের সন্ধান পেয়েছেন কর কর্মকর্তারা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর অঞ্চল-১৫–এর একটি অনুসন্ধানী দল এস আলম পরিবারের কর ফাঁকির বিষয়টি তদন্ত করছে। সে তদন্ত চালাতে গিয়ে মর্জিনা আকতারের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে এ অর্থ পেয়েছেন তদন্তকারীরা।
কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরে ইসলামী ব্যাংকের পাঁচলাইশের এসএফএ টাওয়ার শাখায় ২২টি স্থায়ী আমানতের মাধ্যমে এক কোটি টাকা গচ্ছিত রেখেছেন গৃহকর্মী মর্জিনা আকতার। এসব স্থায়ী আমানত খোলা হয়েছে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি। শুরুতে প্রতিটি এফডিআরে গড়ে সাড়ে চার লাখ টাকা করে রাখা হয়। এখন প্রতিটি এফডিআরের বিপরীতে সুদসহ ৪ লাখ ৭০ হাজার ৯০৩ টাকা জমা হয়েছে। সেই হিসাবে ইসলামী ব্যাংকে মর্জিনা আকতারের ২২টি এফডিআরে জমা আছে ১ কোটি ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬৬ টাকা।
একজন গৃহকর্মীর ব্যাংক হিসাবে কোটি টাকার বেশি জমা থাকায় বিস্মিত কর কর্মকর্তারা। তাঁরা এ অর্থ জব্দ করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু করেছেন। কর কর্মকর্তাদের ধারণা, এই টাকা মর্জিনা আকতারের না–ও হতে পারে। সম্ভবত তাঁর নামে হিসাব খুলে টাকা রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম শহরের প্রবর্তক মোড়ে অবস্থিত ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একটি শাখায় মর্জিনা আকতারের আরেকটি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মিলেছে। হিসাবটি ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খোলা হয়। গত ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ১২ বছরে এ হিসাবে ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে নথিপত্রে দেখা গেছে। বিভিন্ন সময়ে ওই হিসাবে টাকা জমা ও উত্তোলন করা হয়েছে। বর্তমানে ওই হিসাবে উত্তোলনযোগ্য অর্থ নেই বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
গৃহকর্মীর হিসাবে যা আছে: *ইসলামী ব্যাংকে ২২টি এফডিআরের বিপরীতে ১ কোটি ৩ লাখ ৫৯ হাজার ৮৬৬ টাকা *ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হিসাবে ১ কোটি ৮৪ লাখ টাকার লেনদেন *চট্টগ্রামের সুগন্ধার বাসভবনে কাজ করতেন মর্জিনা আকতার *গৃহকর্মীর হিসাবে কোটি টাকা থাকা নিয়ে প্রশ্ন।
জানা গেছে, এস আলম পরিবারের চট্টগ্রাম শহরের সুগন্ধা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত বাসভবনে মর্জিনা আকতার এক যুগেরও বেশি সময় ধরে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। ব্যাংকে দেওয়া নথিপত্রে মর্জিনা আকতারের ঠিকানা হলো মেঘনা ভবন, প্যারেড কর্নার, চকবাজার। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে দুই ব্যাংকে হিসাবগুলো খোলা হয়।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক—দুটোই এস আলম গ্রুপের মালিকানায় ও নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি এই দুটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সাইফুল আলম নিজে আর ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর ছেলে আহসানুল আলম। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংক দুটি এস আলমমুক্ত করা হয়।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নথিপত্রে মর্জিনা আকতারের একটি মুঠোফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। দুই ব্যাংকে তাঁর হিসাবে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন ও আমানতের বিষয়ে জানতে সে নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হয়; কিন্তু প্রতিবারই মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
কর অঞ্চল-১৫–এর কমিশনার আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, কর ফাঁকিবাজদের কাছ থেকে ন্যায্য কর আদায় করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে কর অঞ্চল-১৫–এ থাকা এস আলম পরিবারের সদস্য ও তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাংক লেনদেনের তথ্য যাচাই–বাছাই করা হচ্ছে। এ অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে মর্জিনা আকতারের অর্থের সন্ধান মিলেছে, যা আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যান। তাঁর সরকারের আমলে যেসব ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে, তাদের অন্যতম এস আলম গ্রুপ। গত এক দশকে সাইফুল আলম ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাংক দখল, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এর পেছনে ছিল রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক প্রশ্রয়।
আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কর অঞ্চল-১৫ থেকে দেশের সব বাণিজ্যিক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাক বিভাগে থাকা এস আলম পরিবারের সদস্য (এস আলম, তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীন, মা চেমন আরা, ভাই আবদুল্লাহ হাসান ও তাঁদের ছেলেমেয়ে) এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, আল–আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ইতিমধ্যে তথ্য পেয়েছেন কর কর্মকর্তারা।
এর মধ্যে এক্সিম ব্যাংক ছাড়া বাকি পাঁটটি ব্যাংকই এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওই ছয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, এস আলম পরিবারের সদস্য ও তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে জমা আছে (স্থিতি) ২৫ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সাইফুল আলম ও তাঁর পরিবার এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নামে ওই সব ব্যাংকে থাকা হিসাবে গত পাঁচ বছরে ঢুকেছে (ডিপোজিট হয়েছে) প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহ ভাগই ঋণের অর্থ। এ ছাড়া আবদুল্লাহ হাসানের ব্যাংক হিসাবে নগদ জমা আছে ১ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে সে অর্থ লোপাট ও বিদেশে পাচার করার অভিযোগ আছে। জানা গেছে, এস আলম গ্রুপের নামে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ঋণ আছে।
আয়কর নিয়ে তদন্তের পাশাপাশি ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে এস আলম গোষ্ঠীর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে চট্টগ্রামের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট। চলতি মাসেই নিরীক্ষা দল এর প্রাথমিক প্রতিবেদন দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।