বর্তমানে রপ্তানি ছাড়া অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচকেই নানা ধরনের চাপ দেখা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আহরণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত এবং টাকার বিনিময়ের হারের পর এখন শুরু হয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট। এসবের বিপরীতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো অপর্যাপ্ত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এসব কথা বলেছেন। তিনি বলেন, চলমান সংকটের চরিত্র স্বল্পমেয়াদি নয়, শিগগিরই এটা যাচ্ছে না। বরং ক্রমে তা স্বল্পমেয়াদি থেকে মধ্য মেয়াদের দিকে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে, ২০২৩ সালেও এটার চাপ থাকবে। কিন্তু সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এটা দিয়ে মূল সমস্যা ঢাকা যাবে না।
গতকাল রোববার সকালে সিপিডি আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: কতটা ঝুঁকিপূর্ণ’ শীর্ষক বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও মিডিয়া ব্রিফিংয়ে দেওয়া স্বাগত বক্তব্যে এসব কথা বলেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি সংকট কাটানোর জন্য দ্রুততম সময়ে স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘমেয়াদি—এই তিন ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ দেন।
সংকট কাটাতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে অর্থের অপচয় ও অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ করতে হবে। যতগুলো অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে—ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, ব্যাংকিং খাতের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বহিঃখাত নিয়ে সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান আলোচনা করেন। এ ছাড়া ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে এফবিসিসিআইর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতির ওপর পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বক্তব্য দেন।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একধরনের স্বস্তিকর অবস্থা ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে আমরা ক্রমে বের হয়ে যাচ্ছি। রপ্তানি ছাড়া প্রায় প্রতিটি সূচকেই অনেক ধরনের চাপ দেখা দিচ্ছে। সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অর্থনীতির এই সংকট আরও প্রকট হতে শুরু করেছে। সারা বিশ্বেই অধিক মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ওপরও চাপ পড়ছে। ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে আমরা এই প্রথম এ ধরনের চাপের মধ্যে পড়েছি।’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ পর্যাপ্ত নয় দাবি করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারি তথ্যানুসারে, জুন মাসে মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেড়েছে। এই হিসাবের সঙ্গে কিন্তু বাস্তবতার অনেকখানি ফারাক রয়েছে। এর ব্যাখ্যায় তিনি ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি জুলাই পর্যন্ত কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার উদাহরণ দেন। ফাহমিদা খাতুন বলেন, কোনো কোনো পণ্যের মূল্য ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে; অর্থাৎ বাজারে পণ্যের মূল্য অনেকখানি বেড়েছে। বাজারের এই পরিস্থিতি কিন্তু সরকারি মূল্যস্ফীতির তথ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২২ সালের জন্য ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সেটা কীভাবে হবে, তা বোধগম্য নয়। এই পরিস্থিতিতে অর্থের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কার্যকর করার পরামর্শ দেন তিনি।
সরকারি অর্থায়ন ব্যবস্থাপনা নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, রাজস্ব আহরণ ও সরকারি ব্যয়ের মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্য দূর করতে কৃচ্ছ্রসাধন, প্রকল্প ব্যয় কমানোসহ সুবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থাপনার পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, সেটা আরও কিছুদিন অব্যাহত রাখা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
সরকারি প্রণোদনা নিয়ে ফাহমিদা খাতুন বলেন, কিছু কিছু খাতে এখনো সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধরনের প্রণোদনাগুলো তুলে দেওয়ার সময় হয়েছে।
বাংলাদেশে কর-জিডিপির অনুপাত অনেক কম উল্লেখ করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, এই হার দিয়ে সরকার তার বিরাট খরচ পুষিয়ে উঠতে পারবে না। কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে এখনই একটি মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘সংকট কাটাতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে অর্থের অপচয় ও অতিরিক্ত ব্যয় বন্ধ করতে হবে। যতগুলো অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা অতটা খারাপ না হলেও আমাদের এখন সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে।’