বর্তমানে বিশ্বে জুতার বাজার ৩৮ হাজার ১০০ কোটি ডলারের। ২০২৭ সালে সেটি ৫০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
পায়ের সুরক্ষা কিংবা ফ্যাশনে একসময় চামড়ার জুতার বিকল্পের চিন্তা ছিল অকল্পনীয়। তবে কালের বিবর্তনে সিনথেটিক, রাবার, প্লাস্টিক, কাপড়সহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণে তৈরি জুতা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চামড়ার তুলনায় দামে সস্তা, টেকসই ও ফ্যাশনেবল হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এ ধরনের জুতার বাজার বড় হচ্ছে।
উন্নতমানের চামড়ার বড় ভান্ডার থাকায় বাংলাদেশ থেকে চামড়ার জুতার রপ্তানি এখনো বেশি। তবে চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি প্রতিবছরই বাড়ছে। পাঁচ বছর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ ধরনের জুতার রপ্তানি ছিল ২৪ দশমিক ৪০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ আর গত অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৪ কোটি ৯১ লাখ মার্কিন ডলার। এটা আগের বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুই উৎস প্রবাসী আয়ের পাশাপাশি বেশির ভাগ পণ্যের রপ্তানিও নিম্নমুখী। গত অর্থবছর ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি করে চমক দেখায় কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সেটিও কমেছে। তবে চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় আছে। জুলাই-অক্টোবর সময়ে পণ্যটির রপ্তানি বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমান বিশ্বে বার্ষিক জুতার বাজার ৩৮ হাজার ১০০ কোটি ডলারের। ২০২৭ সালে সেটি ৫০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে চামড়াবিহীন জুতার পরিমাণই বেশি। করোনার পর অনেক বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান জুতার ক্রয়াদেশ নিয়ে ঘুরেছে। তবে সেই ক্রয়াদেশ নেওয়ার মতো পর্যাপ্ত কারখানা না থাকায় সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে। দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ ও সরকারের নীতি সহায়তা পেলে ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যার ও স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে গত বছর বিশ্ববাজার ঘুরে দাঁড়ায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে জুতার উৎপাদন ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি হয়। সব মিলিয়ে গত বছর ২ হাজার ২০০ কোটি জোড়া জুতা উৎপাদিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী। তার মধ্যে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২৯৩ কোটি জোড়া জুতা। আর রপ্তানি হওয়া জুতার প্রায় ৬৮ শতাংশ চামড়াবিহীন।
জুতা ব্যবহারের পেছনে ক্রয়ক্ষমতার চেয়ে মানুষের সংখ্যা কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই দেশের অভ্যন্তরে জুতা বিক্রি কিংবা রপ্তানি—উভয় দিক থেকে চীন সবার ওপরে। গত বছর ৪৩২ কোটি জোড়া কিনেছে চীনারা। ভারতীয়রা কিনেছে ২৫৬ কোটি জোড়া আর মার্কিনরা কিনেছে ২৮৩ কোটি জোড়া। এই তালিকায় বাংলাদেশ দশম। গত বছর সাড়ে ৩৩ কোটি জোড়া জুতা কিনেছে বাংলাদেশিরা।
অন্যদিকে জুতা রপ্তানিতে চীন বরাবরই শীর্ষে। রপ্তানির ৬০ শতাংশ তাদের হাতে। গত বছর চীন ৭৮৮ কোটি জোড়া জুতা রপ্তানি করেছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ১২৩ কোটি জোড়া জুতা। এর পরের শীর্ষ তিন জুতা রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও জার্মানি।
চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানির জন্য ময়মনসিংহের ভালুকায় পরিবেশবান্ধব কারখানা গড়ে তুলেছে ন্যাশনাল পলিমার গ্রুপের শুনিভার্স ফুটওয়্যার। পুরুষ ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের চামড়াবিহীন জুতা উৎপাদন করে। তাদের দৈনিক উৎপাদন সাড়ে ৮ হাজার জোড়া জুতা। শুনিভার্সে কাজ করেন ১ হাজার ২০০ শ্রমিক। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৮৫ লাখ ডলার।
করোনার পর নতুন করে চারটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য জুতা তৈরির কাজ পায় শুনিভার্স। নতুন-পুরোনো ক্রেতাদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানান শুনিভার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিয়াদ মাহমুদ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, করোনার পর চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাচ্ছে অনেক ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ভিয়েতনামে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাচ্ছে। কম্বোডিয়ায় চাহিদা অনুযায়ী শ্রমিক মিলছে না। সব মিলিয়ে আমাদের সামনে বড় সুযোগ। এই খাতের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ৯৯ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি করতে হয়।
চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানির জন্য এক যুগ আগে চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে ম্যাফ সুজ। আড়াই কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটি চপ্পল, কেডস, স্নিকারসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি করে। তাদের কারখানায় কাজ করে সাড়ে নয় হাজার কর্মী। গত অর্থবছরে ৭ কোটি ৬০ লাখ ডলারের জুতা রপ্তানি করেছে ম্যাফ সুজ।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা প্রথম আলোকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ফলে বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রচুর পণ্য অবিক্রীত পড়ে আছে। সে কারণে নতুন ক্রয়াদেশ আসছে না। এমনকি চলমান ক্রয়াদেশের উৎপাদিত পণ্যও জাহাজীকরণের অনুমতি দিচ্ছে না ক্রেতারা। ফলে আগামী কয়েক মাস আমাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে।
ম্যাফ সুজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, চামড়াবিহীন জুতার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে শুরু করেছে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। ফলে চামড়াবিহীন জুতার ব্যবসায় বড় হিস্যা নিতে হলে দেশি-বিদেশি নতুন বিনিয়োগ প্রয়োজন। সে জন্য উদ্যোক্তাদের আস্থায় নিতে হবে। নীতি সহায়তা দিয়ে সরকার সহজেই এটি করতে পারে।