এই সংকটের মধ্যে ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খরচ বাড়ছে মানুষের।
ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ব্যাংকগুলোর দামকে স্বীকৃতি দেওয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আন্তব্যাংকে ডলারের বিক্রয়মূল্য ঘোষণা করা হয় ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা। এত দিন আন্তব্যাংকে ডলারের ক্রয়-বিক্রয়মূল্য ৯৫ টাকায় আটকে রেখেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পাশাপাশি ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরও কমিয়ে বাজারের দামের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার ডলারের দাম ৯৬ টাকা করা হয়েছে। এই দামে গতকাল রিজার্ভ থেকেও ডলার বিক্রয় করা হয়েছে।
এদিকে ব্যাংকগুলো নিজেরা ডলারের দাম নির্ধারণের পর কিছু আমদানিকারকের খরচ বেড়ে গেছে। বিশেষ করে যারা সরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে আমদানি করে থাকে। কারণ, সরকারি ব্যাংকগুলোও বেসরকারি ব্যাংকের মতো ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সব ব্যাংকই ক্রেডিট কার্ড ও বিদেশে শিক্ষার্থীদের খরচ পাঠাতে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আন্তব্যাংকে ডলারের দামের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে ডলারের ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে ১০১ টাকা ৬৭ পয়সা ও বিক্রয়মূল্য ১০৬ টাকা ১৫ পয়সা। এত দিন ক্রয় ও বিক্রয়মূল্য দুটোই ৯৫ টাকা ছিল। আবার গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯৬ টাকা দামে রিজার্ভ থেকে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করে।
ফলে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কোনটি হবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, এত দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে থাকা আন্তব্যাংক দরই ছিল ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম। ডলারের আনুষ্ঠানিক দামকে বিবেচনায় নিয়েই দেশের অর্থনীতির হিসাব–নিকাশ করা হয়। এ ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারী ও সহযোগী সংস্থাগুলোও এই দরকে বিবেচনায় নিয়ে থাকে।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যে কৌশল টেকসই হবে, তা–ই বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এ নিয়ে সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারেননি। সংস্থাটির মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ৯৬ টাকা দামে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি হয়েছে। আর যেটা প্রকাশ করা হয়েছে, তা ব্যাংকগুলোর কেনাবেচার দাম। সরকারি দাম কত, তা নির্ধারিত হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) শীর্ষ নেতারা গত রোববার এক সভায় বিভিন্ন লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করেন। এতে রপ্তানি আয়ে ডলারের দাম ৯৯ টাকা ও প্রবাসী আয়ে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ফলে ডলার সংগ্রহে গড়ে সর্বোচ্চ খরচ হয় ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা। এ ক্ষেত্রে আমদানিকারকদের কাছে প্রতি ডলারের দাম সর্বোচ্চ ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা নেওয়ার কথা।
তবে সোমবার আমদানি দায় পরিশোধে প্রতি ডলারের জন্য ১০৮ টাকা ৭৮ পয়সা পর্যন্ত দাম দিতে হয় আমদানিকারকদের, গতকাল যা ১১০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এদিকে সরকারি ব্যাংকগুলো আগে আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে রাখলেও নতুন সিদ্ধান্তের ফলে তারাও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। গতকাল সোনালী ব্যাংক আমদানি দায় নিষ্পত্তিতে প্রতি ডলারের দাম নিয়েছে ১০৭ টাকা ৫৮ পয়সা, জনতা ব্যাংক ১০৬ টাক ১৫ পয়সা ও অগ্রণী ব্যাংক ১০৪ টাকা ১৫ পয়সা। অথচ গত সপ্তাহেও তা ১০০ টাকার নিচে ছিল।
যেই ব্যাংকে ডলার সংগ্রহে খরচ যত, তাদের আমদানি বিলে ডলারের দামও তত বেশি। গতকাল পূবালী ও ন্যাশনাল ব্যাংকে ডলারের গড় ক্রয়মূল্য ছিল ১০৯ টাকা, ইসলামী ও সিটি ব্যাংকে ছিল ১১০ টাকা।
বাফেদার চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ব্যাংকের রপ্তানি আয় নেই, তাদের ক্ষেত্রে ডলারের দাম বেশি হবে। কারণ, প্রবাসী আয় ১০৮ টাকা দিয়ে কিনতে হবে। তবে সব ক্ষেত্রে দাম ১০৮ টাকার মধ্যে থাকবে। সোনালী ব্যাংক বাজারকে বিবেচনায় নিয়ে আমদানিতে ডলারের দাম বাড়িয়েছে, যা সবার জন্য প্রযোজ্য হবে।
বাফেদা ও এবিবির সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ক্রেডিট কার্ড ও বিদেশে শিক্ষাখরচে প্রতি ডলারের দাম হবে ব্যাংকের নগদ ডলার বিক্রির দামে। গত রোববার থেকে ব্যাংকগুলো এই দুই খাতে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশে উচ্চশিক্ষায় পাঠানো অভিভাবকদের খরচ বেড়ে গেছে।
গতকাল বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের বিল দিতে আসেন বেসরকারি চাকরিজীবী মহররম হোসেন। তাঁর কাছে ব্যাংকটি প্রতি ডলারের জন্য ১০৭ টাকা দাম নেয়, আগে যা ছিল ৯৯ টাকা।
মহররম হোসেন অভিযোগ করে প্রথম আলোকে বলেন, এখন নাকি সংকট কমে আসছে। তাহলে হঠাৎ করে প্রতি ডলারে ৮ টাকা বাড়ানোর কোনো যুক্তি হতে পারে না। কার্ডে তো নগদ ডলার খরচ হয় না, তাহলে এত দাম কেন বাড়বে।
এদিকে ব্যাংকগুলো শিক্ষাখরচের জন্য অর্থ পাঠাতে প্রতি ডলারের দাম ১০০ টাকার ওপরে রাখছে। কোনো কোনো ব্যাংক তা ১০৭ টাকাও রাখছে।
এদিকে শুধু প্রবাসী আয়ে ১০৮ টাকা দাম দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। অন্য আয়ে সর্বোচ্চ ৯৯ টাকা দাম দিচ্ছে। ফলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ফ্রিল্যান্সার ও ডলার আয় করা বিভিন্ন খাতের কর্মজীবীরা। কারণ, তাঁরা আয়ের জন্য আড়াই শতাংশ হারে সরকারি প্রণোদনা পাচ্ছেন। তবে ডলারে দাম কম পাচ্ছেন।
ভারতের জাহাজ কোম্পানিতে কর্মরত এম হাফিজুর রহমান গতকাল সিঙ্গাপুর থেকে ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও ডলার আয় করি। আড়াই শতাংশ প্রণোদনাও পাই। কিন্তু ব্যাংক ৯৯ টাকার বেশি দিতে চাইছে না। অথচ প্রবাসী আয়ে ১০৮ টাকা দিচ্ছে। এই বৈষম্য দূর করতে হবে।’
এদিকে প্রবাসী আয়ে সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা দাম দেওয়ায় অনেকেই এখনই বৈধ পথে পাঠাতে আগ্রহ হারাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসের কর্মীরা। কারণ, হুন্ডি করলে এর চেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে। তবে তাঁরা বলছেন, সব ব্যাংক ১০৮ টাকার নিচে দাম দিয়ে রাখলে পরিস্থিতি উত্তরণ হবে। প্রবাসীরা তাহলে ব্যাংকের মাধ্যমে আয় পাঠাতে বাধ্য হবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগের পর আমদানি খরচ কিছুটা কমেছে। ফলে ডলারের চাহিদা কিছুটা কমে এসেছে। এদিকে ব্যাংকগুলোর সিদ্ধান্তের পর নিজেদের মধ্যে ডলার কেনাবেচা আবার শুরু হয়েছে। গতকাল কয়েকটি ব্যাংক নিজেদের মধ্যে ১ কোটি ১৮ লাখ ডলার বেচাকেনা করেছে। গত সোমবার করেছিল ২২ লাখ ডলার।
এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ও ছোট ব্যাংকগুলোর ডলার আয় নেই। আমরা কেনা দামেই তাদের কাছে ডলার বিক্রি করেছি। আশা করছি অল্প সময়ে ডলারের দাম ১০৫ টাকার নিচে চলে আসবে। তখন পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে আসবে।’