৭৪ বছর পর হচ্ছে নতুন আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন

নতুন আইনে পণ্যের সঙ্গে সেবা খাত যুক্ত করা হচ্ছে। তবে বিদ্যমান আইনের মতো এবার ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটি আর রাখা হচ্ছে না।

চট্টগ্রাম বন্দর

বাংলাদেশে এখনো স্বাধীনতা অর্জনের ২১ বছর আগে প্রণীত আমদানি ও রপ্তানি (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ১৯৫০ চলছে। তবে এটি আর থাকছে না। বহু আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ৭৪ বছর পর যুগোপযোগী করে নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটির নাম ‘আমদানি ও রপ্তানি আইন, ২০২৪’। নতুন আইনের শিরোনামে আমদানি ও রপ্তানি ‘নিয়ন্ত্রণ’ শব্দটির উল্লেখ থাকবে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর (সিসিআইই) নতুন আইনের খসড়া তৈরি করে সম্প্রতি তাদের কাছে পাঠিয়েছে। আগামী ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে খসড়াটির ওপর যে কেউ মতামত দিতে পারবেন।

অনেক দেরিতে হলেও আইনের বদল হচ্ছে, এটা ভালো কথা। আমরা স্বাগত জানাই। তবে আমরা চাই সহজ ও ভোগান্তিমুক্ত সেবা। সেবা দেওয়ার আড়ালে যাতে গোপন কোনো জটিলতা না থাকে, তাহলেই নতুন আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হবে।
মো. ফজলুল হক, সাবেক সভাপতি, বিকেএমইএ

প্রধান আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রক শেখ রফিকুল ইসলাম গতকাল শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো পণ্য ও সেবা আমদানি বা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার জন্য নতুন করে আইনটি করা হচ্ছে। এ আইন হওয়ার পর আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকসহ সব ধরনের ব্যবসায়ীই অধিকতর সেবা পাবেন বলে আমরা আশা করি।’

আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ ও সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণ, বৈদেশিক বাণিজ্য উন্নয়ন ও ক্ষেত্রবিশেষে কোনো কোনো পণ্য ও সেবা আমদানি বা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করা সমীচীন ও দরকারি। তাই আইনটি নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি পঞ্জিকা বছরে আইন পাস করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খসড়াটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে। কিন্তু সরকারের বর্তমান মেয়াদে যেহেতু আর সংসদের অধিবেশন বসার সুযোগ নেই সেহেতু এ বছর আর তা পাস হওয়ার সুযোগ নেই। সে জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খসড়ার ওপর মতামত পাওয়ার পর আরেকটি পরামর্শক বৈঠক করবে। আইনি পরীক্ষার জন্য এক দফায় তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে এই আইন পাসের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

বিদ্যমান আমদানি ও রপ্তানি (নিয়ন্ত্রণ) আইনটি যখন প্রণীত হয়েছিল, তখন এতে শুধু পণ্য আমদানি ও রপ্তানির কথা বলা হয়। সে জন্য নতুন আইনে পণ্যের পাশাপাশি সেবা আমদানি ও রপ্তানির কথাও বলা হচ্ছে। বিদ্যমান আইন ১৯৬২ সালে একবার এবং পরে বাংলাদেশ আমলে ১৯৭৫ সালে আরেকবার সংশোধন করা হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সিসিআইইর কাজকে যুগোপযোগী করা হলেও আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবারই প্রথম।

বিদেশ থেকে পণ্য ও সেবা আমদানি করতে গেলে সিসিআইই থেকে আমদানি অনুমতির সনদ (আইআরসি) নিতে হয়। আর বিদেশে পণ্য রপ্তানি করতে গেলেও একই দপ্তর থেকে নিতে হয় রপ্তানির অনুমতি সনদ (ইআরসি)। উভয় ক্ষেত্রেই একাধিক শর্ত থাকে, যেগুলো আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের মানতে হয়।

কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে এক বছরের জেল বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার কথা বলা আছে বিদ্যমান আইনে। নতুন আইনের খসড়ায় জেলে থাকার বিধান এক বছরই রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে জরিমানার পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, তা হবে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা।

বিদ্যমান আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘনের দায়ে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিচার হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, অপরাধের বিচার হবে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে। নতুন আইনে ‘প্রথম শ্রেণি’ কথাটি বাদ দেওয়া হয়েছে।

আরও বলা হয়েছে, আইনের মূল পাঠ বাংলায় হবে এবং সরকার প্রয়োজন মনে করলে মূল পাঠের ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ প্রকাশ করবে। বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে কোনো বিরোধ হলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাবে। আর নতুন আইন পাস হওয়ার পর রহিত হয়ে যাবে ১৯৫০ সালের আইন।

সিসিআইই থেকে ইআরসি নিয়ে যেসব রপ্তানিকারক পণ্য রপ্তানি করে থাকেন, তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে গতকাল শনিবার প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁদের প্রায় সবার একই বক্তব্য, আইনটি যুগোপযোগী হওয়ার দরকার ছিল আগেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং সিসিআইইর উদ্যোগের অভাবেই এটি এত দিন পড়ে ছিল।

নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক দেরিতে হলেও আইনের বদল হচ্ছে, এটা ভালো কথা। আমরা স্বাগত জানাই। তবে আমরা চাই সহজ ও ভোগান্তিমুক্ত সেবা। সেবা দেওয়ার আড়ালে যাতে গোপন কোনো জটিলতা না থাকে, তাহলেই নতুন আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ হবে।’

আমদানি ও রপ্তানিতে বিশ্বের কোথাও এখন আর পারতপক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা হয় না—এ কথা উল্লেখ করে ফজলুল হক বলেন, ‘সেদিক থেকে নতুন আইনের নামকরণে ‘‘নিয়ন্ত্রণ” শব্দটি থাকছে না জেনে ভালো লাগছে।’