বিশ্বায়িত পৃথিবীতে নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমোদন বিক্রয় অনেক দেশের রাজস্ব আয়ের বড় উৎস হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের ধনী মানুষেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে উন্নত দেশের নাগরিকত্ব বা বসবাসের অনুমোদন পাচ্ছেন, যা গোল্ডেন ভিসা হিসেবে বহুল পরিচিত।
জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক পরিসংখ্যান প্রস্তুতকারী সংস্থা স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুসারে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত গোল্ডেন পাসপোর্ট ও ভিসা বিক্রি করে প্রায় ২১ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৪০ কোটি ইউরো উপার্জন করেছে। গোল্ডেন ভিসার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতও বিশ্বের ধনীদের কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে। তবে এই প্রক্রিয়া সম্প্রতি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আগপর্যন্ত সাইপ্রাস, মাল্টা ও বুলগেরিয়া সিটিজেনশিপ বাই ইনভেস্টমেন্ট বা বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব (সিবিআই) দিয়েছে, যা কার্যত গোল্ডেন পাসপোর্ট হিসেবে পরিচিত। এই বিনিয়োগ করে এসব দেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই নাগরিকত্ব পাওয়া যায়।
তবে বুলগেরিয়া ও সাইপ্রাস এই গোল্ডেন পাসপোর্ট প্রথা বাতিল করেছে। মাল্টা রাশিয়া ও বেলারুশের নাগরিকদের এই পাসপোর্ট দেবে না। তবে এখনো ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশে এই প্রথা আছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর স্পেন বলেছিল, তারা রুশ নাগরিকদের গোল্ডেন ভিসা দেবে না। কিন্তু শেনঝেনভিসাইনফো ডট কমের তথ্যানুসারে, তারা এখনো ধনী রুশ নাগরিকদের গোল্ডেন ভিসা দিচ্ছে। পাঁচ লাখ ইউরোর বিনিময়ে রুশ নাগরিকদের বসবাসের অনুমতি দিচ্ছে তারা। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, অর্থনীতি চাঙা রাখতেই স্পেন রুশ নাগরিকদের এই ভিসা দিচ্ছে।
স্ট্যাটিস্টা বলছে, দক্ষিণ ইউরোপে বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের অনুমতি (আরবিআই) শীর্ষক কর্মসূচি এখনো প্রচলিত। সম্প্রতি পর্তুগাল ও আয়ারল্যান্ড এই প্রথা বাতিল করলেও স্পেন, গ্রিস, সাইপ্রাস, মাল্টাসহ অনেক দেশ বিনিয়োগের বিনিময়ে বসবাসের অনুমতি দিচ্ছে।
ইউরোপীয় কমিশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১১-২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষ সিবিআই ও আরবিআইয়ের অধীনে ইউরোপে এসেছে।
যে আকাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগের কারণে দেশগুলো গোল্ডেন ভিসা দিচ্ছে, সেই বিনিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে সমস্যাজনক হয়ে উঠছে। অধিকাংশ দেশে সম্পদ ক্রয় বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এতে স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। পর্তুগাল গোল্ডেন ভিসা বাতিল করেছে আবাসন-সংকটের কারণে। বিদেশিরা বাড়ি কেনায় সেখানে বাড়ির দাম ও ভাড়া আকাশ ছুঁয়েছে—স্থানীয়দের নাগালের বাইরে চলে গেছে আবাসন—কানাডায়ও এই সমস্যা হচ্ছে।
স্ট্যাটিস্টার তথ্যানুসারে, পাঁচ লাখ ইউরো বিনিয়োগ বা সমমূল্যের আবাসন ক্রয়ের শর্তে পর্তুগাল এত দিন গোল্ডেন ভিসা দিয়েছে। আবার যেসব স্থানে জনবসতি কম, সেখানে এর চেয়ে কম অর্থ বিনিয়োগের বিনিময়েও এই ভিসা দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় পর্তুগালে গত কয়েক বছরে ৬০০ কোটি ইউরো বিনিয়োগ এসেছে। এর বিনিময়ে তারা পাঁচ বছর বসবাসের ভিসা দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত পর্তুগাল শেনঝেন ভিসারও অংশীদার। এতে গোল্ডেন ভিসা পাওয়া মানুষেরা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বিনা বাধায় ঘোরাফেরা করতে পারেন। তার পাঁচ বছর পর স্থায়ী বসবাস ও নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন। সেটা পেলে ইউনিয়নভুক্ত যেকোনো দেশে বসবাস ও কাজ করা যায়। এখানেই বিপত্তি। যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার এটি অন্যতম কারণ।
ইদানীং ইউরোপীয় কমিশন, কাউন্সিল অব ইউরোপ ও ধনী দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডি অভিবাসীদের এই অর্থের উৎস নিয়ে সোচ্চার হয়েছে। তাদের উদ্বেগ, উন্নয়নশীল দেশের মানুষেরা অর্থ পাচার বা কর ফাঁকির মাধ্যম হিসেবে এই গোল্ডেন ভিসা ব্যবহার করছেন। এতে নানা ধরনের জালিয়াতির সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালে চীনা নাগরিকেরা গ্রিসে এ ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এক গ্রিক ডেভেলপার বাজারমূল্যে জমি কিনে সম্ভাব্য চীনা অভিবাসীদের কাছে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করেন। সেই অর্থের একাংশ আবার চীনা বিনিয়োগকারীদের কমিশন হিসেবে দেয় সেই ডেভেলপার—এমন ঘটনাও দেখা গেছে।
এদিকে সম্প্রতি বিশ্বের ধনীদের কাছে বসবাসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে দুবাইয়ে রেকর্ডসংখ্যক জমি-বাড়ি বেচাকেনা হয়েছে। দেশটির সরকারি নথি অনুসারে, গত বছর দুবাইয়ে মোট ৯০ হাজার ৮৮১টি জমি ও বাড়ি কেনাবেচা হয়েছে। দেশটিতে এক কোটি দিরহাম বিনিয়োগ করা হলে গোল্ডেন ভিসা দেওয়া হয়।
জানা যায়, উন্নয়নশীল ও কর্তৃত্বপরায়ণ জমানার দেশগুলো থেকে বেশি অর্থ পাচার হয়। কর ফাঁকি দিতেও অনেকে এমন জায়গায় অর্থ পাচার করেন, যেখানে করহার কম। এসবই একরকম পাচার। এতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো অতিপ্রয়োজনীয় রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়। জনগণের স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারে না তারা।
বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে, সে জন্য জিডিপির অনুপাতে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণও খুব কম। বঞ্চিত হয় দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ।