চলমান ডলার-সংকটের মধ্যে বিদেশি ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা এবং চীন, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া কঠিন শর্তের অনেক ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। এ কারণে দ্রুত বাড়ছে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ, যা আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়বে।
সরকার ১০ বছর আগে বছরে যে পরিমাণ বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করত, এখন পরিশোধ করতে হয়েছে তার দ্বিগুণের বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, যদি সরকার নতুন করে আর বিদেশি ঋণ না নেয়, তারপরও সাত বছর পরে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখনকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হবে।
দ্বিপক্ষীয় ঋণ নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল-সংযোগ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আরও অনেক প্রকল্প হচ্ছে বিদেশি ঋণে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঋণ পরিশোধের সময়কাল কম। এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হওয়ায় সার্বিক ঋণ পরিস্থিতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এসব ঋণে বাস্তবায়িত বড় প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি পাওয়া শুরু হয়নি।
যেমন ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করা হয়। এতে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি চীনা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এই পথে এখন দিনে দুটি ট্রেন চলাচল করে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সব মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। পরের বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধ বাড়তেই থাকবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হয়নি। ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে রাশিয়ার কাছ থেকে ১ হাজার ১৩৮ কোটি মার্কিন ডলার (১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন) ঋণ নেওয়া হচ্ছে, যা বর্তমান মূল্যে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের এই চাপ বাড়ছে এমন সময়ে, যখন দেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডলার-সংকটের মধ্যে রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছে। কারণ, প্রবাসী আয় কাঙ্ক্ষিত হারে আসছে না। রপ্তানি আয়ও আশানুরূপ নয়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেলসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিদেশি ঋণের রেয়াতি সময় (গ্রেস পিরিয়ড) শেষ হয়ে যাচ্ছে। ঋণ পরিশোধের সময় চলে আসছে। কোনো কোনো প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। এসব কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে।
জাহিদ হোসেন বলেন, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধে টাকার অঙ্কেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে, যা বাজেটের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। সে অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ডলারের জোগান না বাড়লে বৈদেশিক লেনদেনে বড় ঘাটতি তৈরি হবে।
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক লেনদেনে বহুল ব্যবহৃত ‘সুইফট সিস্টেম’ থেকে বাদ দেয় পশ্চিমারা। ফলে রূপপুরের ঋণের কিস্তির অর্থ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঋণের এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষায়িত হিসাবে রাখা হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং ভবিষ্যতে ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। এই প্রতিবেদনে আগামী কয়েক বছরে ঋণ নেওয়া এবং ঋণ পরিশোধের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দেশের এখন বিদেশি ঋণ রয়েছে ৭ হাজার ৭৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পে নেওয়া ঋণ ৬ হাজার ২০০ কোটি ডলারের মতো, যা ১০ বছরে আড়াই গুণ বেড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সরকারি পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকবে। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে হবে ৮ হাজার ৫২৪ কোটি ডলার। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে পুঞ্জীভূত ঋণ কিছুটা কমে হবে ৭ হাজার ২৯১ কোটি ডলার। এই হিসাব তৈরিতে ধরে নেওয়া হয়েছে যে নতুন করে কোনো বিদেশি ঋণ নেওয়া হবে না এবং শুধু প্রতিশ্রুত অর্থাৎ, পাইপলাইনে থাকা ঋণের অর্থই ছাড় করা হবে। জানা গেছে, বর্তমানে পাইপলাইনে প্রায় ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ রয়েছে।
বিগত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সব মিলিয়ে ৩২৮ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগামী অর্থবছরে তা ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। পরের বছরগুলোতে ঋণ পরিশোধ বাড়তেই থাকবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছর নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে ৫১৫ কোটি ডলারে। এরপর ঋণ শোধ কমতে থাকবে।
ঋণ পরিশোধ পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে ইআরডি সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করা হয়েছে।
কিন্তু সমস্যা হলো ঋণ পরিশোধের সময় নিয়ে। চীন, রাশিয়াসহ দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে প্রতিটি কিস্তিতে বেশি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ে ঋণ পরিশোধ আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস সময়ে সুদ ও আসল মিলিয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীদের ১৫৬ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১০৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেশি বেড়েছে বিগত এক-দুই বছরে। ইআরডির হিসাব অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল হিসেবে সব মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে, আগের বছর যা ছিল ২০১ কোটি ডলার।
কিছু কিছু বড় প্রকল্পের ঋণ শোধ শুরু হয়েছে, যার একটি রূপপুর। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০১৬ সালে ঋণ নেওয়া হয়। এর গ্রেস পিরিয়ড ১০ বছর। আর ১০ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অবশ্য এর আগে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য রাশিয়ার কাছে থেকে ৫০ কোটি ডলার নেওয়া হয়েছিল। সেটার কিস্তি দিতে হচ্ছে। ২০২৬ সাল থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল ঋণের অর্থ পরিশোধ শুরু হবে।
ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার ব্যাংকগুলোকে আন্তর্জাতিক লেনদেনে বহুল ব্যবহৃত ‘সুইফট সিস্টেম’ থেকে বাদ দেয় পশ্চিমারা। ফলে রূপপুরের ঋণের কিস্তির অর্থ পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে ঋণের এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষায়িত হিসাবে রাখা হচ্ছে। গত দেড় বছরে তিন কিস্তিতে ৩৩ কোটি ডলার রাখা হয়েছে, যা ঋণ পরিশোধ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধকাল মিলিয়ে রূপপুরের ঋণের মেয়াদ ২০ বছর। তবে মেট্রোরেল-৬-এর জন্য জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে বাংলাদেশ সময় পাচ্ছে অন্তত ৩০ বছর। মেট্রোরেলের জন্য নেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকার ঋণ।
পদ্মা সেতুর ঋণ পরিশোধের বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির। সেতুটি নির্মাণের জন্য ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে সেতু কর্তৃপক্ষকে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেতু কর্তৃপক্ষ তা পরিশোধ করছে। তবে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি সমপরিমাণ অর্থ ডলারে পরিশোধ করা হয়েছে। এটিও ডলারের মজুতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।
চীনা ঋণের অর্থে বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ এখনো শুরু হয়নি।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতের তুলনায় অবশ্য বাংলাদেশের ঋণ পরিস্থিতি এখনো গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে আছে। জিডিপির অনুপাতে দেশি-বিদেশি ঋণের হার এখনো ৩৫ শতাংশের নিচে। আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) হিসাবে, এই হার ৫৫ শতাংশের নিচে থাকলে তাকে নিরাপদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে ঋণ পরিশোধ নিয়ে চাপের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ দেড়-দুই বছর ধরে চলা তীব্র ডলার-সংকট। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালেও বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ছিল ৪৮ বিলিয়ন (১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন) ডলার, যা এখন ২৫ বিলিয়নে নেমেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, জিডিপির সঙ্গে নয়, সরকারের রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে ঋণ পরিস্থিতির তুলনা করতে হবে। সে অনুপাতে বাংলাদেশের অবস্থা দুশ্চিন্তাজনক।
বাংলাদেশের জন্য ঋণ গ্রহণ ও ঋণ শোধে শীর্ষ পাঁচটি সংস্থা ও দেশ হলো বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান, চীন ও রাশিয়া। বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুপক্ষীয় সংস্থার ঋণ এবং চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দ্বিপক্ষীয় ঋণের সুদের হার প্রায় সমান। সেবা মাশুলসহ সব মিলিয়ে সুদের হার ২ শতাংশের আশপাশেই থাকে।
কিন্তু সমস্যা হলো ঋণ পরিশোধের সময় নিয়ে। চীন, রাশিয়াসহ দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে প্রতিটি কিস্তিতে বেশি পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণ গ্রেস পিরিয়ড বাদে ৩০-৩২ বছরে পরিশোধ করতে হয়।
হিসাব করে দেখা গেছে, চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিলে গ্রেস পিরিয়ড বাদে পরবর্তী ১০ বছরে ঋণ ফেরত দিতে হলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে গড়ে ১০ কোটি ডলার। আর একই পরিমাণ বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে নিলে বছরে আসল পরিশোধ করতে হবে গড়ে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ডলার।
অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতে প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রের মাধ্যমে বিদেশি ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নে সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি যেসব প্রকল্পে বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্ন (সুফল) কম, সেসব প্রকল্প না নেওয়াই ভালো। কারণ, এখন ঋণের সুদাসল পরিশোধই সরকারের বাজেটের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খাত।