ইপিবি গত তিন অর্থবছরের ৩৪ মাসে এনবিআরের চেয়ে ২ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের রপ্তানি বেশি দেখিয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য নিয়ে পণ্য রপ্তানির হিসাব প্রকাশ করে আসছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। গত ১০ বছরের মধ্যে ৯ বছরই এনবিআরের চেয়ে রপ্তানির হিসাব বেশি দেখিয়েছে ইপিবি। তবে গত তিন অর্থবছরের রপ্তানির হিসাবে বড় গরমিল হয়েছে।
দুই সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত তিন অর্থবছরের ৩৪ মাসে এনবিআরের চেয়ে ২ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের রপ্তানি বেশি দেখিয়েছে ইপিবি। তার মধ্যে সংস্থাটি বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রপ্তানি বেশি দেখিয়েছে ১ হাজার ৭০ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংক গত বুধবার হঠাৎ প্রকৃত পণ্য রপ্তানির ভিত্তিতে লেনদেন ভারসাম্যের তথ্য প্রকাশ করে। ফলে পণ্য রপ্তানির হিসাবের গরমিলের তথ্য উঠে আসে। এতে গত দুই অর্থবছরের ২০ মাসে রপ্তানির ২ হাজার ৩৩৪ কোটি ডলার উধাও হয়ে যায়। এ সময়ে ৯ হাজার ৩১৪ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল ইপিবি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ ৬ হাজার ৯৮০ কোটি ডলারের। তার মানে, ২৫ শতাংশ রপ্তানির হদিস নেই।
জানা যায়, এক দশক আগেও এনবিআরের প্রাথমিক হিসাব যাচাই-বাছাই করে প্রকাশ করত ইপিবি। ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের প্রকাশ করা প্রকৃত রপ্তানির হিসাব এনবিআরের চেয়ে কিছুটা কম হতো। যেমন গত ২০০৮-০৯ অর্থবছরের ১ হাজার ৬৯৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির প্রাথমিক হিসাব দিয়েছিল এনবিআর। শেষ পর্যন্ত ১ হাজার ৫৫৭ কোটি ডলারের রপ্তানির হিসাব দেয় ইপিবি। একইভাবে ২০১৩-১৪ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এনবিআরের তুলনায় ইপিবি যথাক্রমে ১৭৯ ও ২৫০ কোটি ডলারের কম রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে এনবিআরের প্রাথমিক হিসাবের তুলনায় ইপিবি রপ্তানির হিসাব বেশি দেখায়। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে সেটিই নিয়মে পরিণত হয়। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এনবিআরের প্রাথমিক হিসাবের তুলনায় ৫৫ কোটি থেকে ১৭৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি বেশি দেখায় ইপিবি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটি বেড়ে ২৯৪ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ওই অর্থবছর এনবিআর প্রাথমিকভাবে ৪ হাজার ৯১৩ কোটি ডলারের রপ্তানির তথ্য দিয়েছিল। যদিও ইপিবি জানায়, পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৫ হাজার ২৮০ কোটি ডলারের।
এনবিআর ২০২২-২৩ অর্থবছরে তার আগের অর্থবছরের তুলনায় কম পণ্য রপ্তানির তথ্য দেয়। সংস্থাটির হিসাবে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৬৯৫ কোটি ডলারের পণ্য। যদিও ওই অর্থবছর রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানায় ইপিবি। তারা জানায়, পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৫৫৭ কোটি ডলার।
একইভাবে বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ৩ হাজার ৬৭৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির তথ্য দেয় এনবিআর। তবে ইপিবি জানায়, ওই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ ৩ হাজার ৩৬৭ কোটি ডলার।
রপ্তানির হিসাবে গরমিলের কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, একই রপ্তানির তথ্য এবং পণ্যের এইচএস কোড একাধিকবার ইনপুট দেওয়া হয়েছে। পণ্যের কাটিং, মেকিং ও ট্রিমিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু তৈরির মাশুল হিসাব হওয়ার কথা; কিন্তু ইপিবি কাপড়সহ সব যন্ত্রাংশের হিসাব করেছে। এ ছাড়া রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) থেকে দেশের অভ্যন্তরে বিক্রয়কে রপ্তানি হিসাবে এবং এসব পণ্য আবার বিদেশে রপ্তানির সময়ও হিসাব করা হয়েছে।
সাধারণত পণ্য রপ্তানির সময় রপ্তানির প্রাথমিক ঋণপত্র (এলসি) মূল্য থেকে কিছুটা কম হয়ে থাকে, যা ইপিবি সমন্বয় করে না। এ ছাড়া স্টকলট, ডিসকাউন্ট ও কমিশনের কারণে ক্ষয়ক্ষতি ইপিবির হিসাবে সমন্বয় করা হয় না।
জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন গতকাল দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানি হিসাবে অসংগতির যেসব কারণ পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছে, তা সবই ঠিক আছে। এ অসংগতির পেছনে সব কটি কারণই কমবেশি দায়ী। তবে ঠিক কোন হিসাবের কারণে বড় ধরনের অসংগতি হয়েছে, তা এখনো চিহ্নিত করা হয়নি বলে জানান তিনি।
ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত ৯ অর্থবছরে ৩৫ হাজার ২৭৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে রপ্তানি আয় দেশে এসেছে ৩০ হাজার ৮৬৯ কোটি ডলারের। তার মানে ৪ হাজার ৪০৯ কোটি ডলার দেশে আসেনি। যদিও এনবিআরের হিসাব ধরলে রপ্তানি আয় আসেনি ২ হাজার ৭২২ কোটি ডলার।
পণ্য রপ্তানির জাহাজীকরণের হিসাবের সঙ্গে ব্যাংকের ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তির তথ্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে রপ্তানির গরমিল বা ত্রুটি এড়ানো সম্ভব বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ নিয়ে এনবিআরও ইপিবির হিসাবের অসামঞ্জস্য দূর করা দরকার। একই সঙ্গে রপ্তানির অর্থ প্রত্যাবাসনে গরমিল কমিয়ে আনতে ঋণপত্র পর্যবেক্ষণ করা দরকার। সেটি করা গেলে রপ্তানি আয় দেশে আসা বাড়বে।