জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তার সদস্যদের ঋণ দেয়। এটা একটা সাধারণ বিষয়। ঋণ অবশ্য আইএমএফ কখনো এমনি এমনি দেয় না, সঙ্গে বিভিন্ন শর্ত দেয়। সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এবার যে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে, তাতেও নানা শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। শর্তগুলো মেনেও নিয়েছে সরকার।
ঋণ প্রস্তাব গত ৩০ জানুয়ারি অনুমোদিত হওয়ার এক সপ্তাহ আগেই অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার যৌথভাবে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কোন শর্ত কীভাবে পূরণ করবেন তাঁরা। সাধারণভাবে বলা যায়, আইএমএফের শর্তগুলো মানলে আখেরে উপকারই হবে বাংলাদেশের। যদিও তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কবলে রয়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সরকারের মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর যে দায়িত্ব বা যে কাজ তাদের নিজেদেরই করার কথা, তা এখন করা হবে আইএমএফের কথায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটা কেন হবে? এর একটা সহজ উত্তর হতে পারে, যে সরকারি দপ্তরগুলো নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে না, এখন ঋণ নেওয়ার ‘চিপায়’ পড়ে সেই দায়িত্ব পালন করবে। তবে এটা কোনোভাবেই শুভ বিষয় হতে পারে না।
উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা সামনে আনা যায়। সাত হাজার থেকে আট হাজার জনবলবিশিষ্ট সংস্থা এটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি এড়িয়ে রিজার্ভ, অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার হিসাবই করে আসছিল নিজের মতো করে। যে রিজার্ভ দিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠন করা হয়েছে, যে রিজার্ভ শ্রীলঙ্কাকে ধার দেওয়া হয়েছে, যে রিজার্ভ সোনালী ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে উড়োজাহাজ কেনায় ঋণ দিতে, যে রিজার্ভ পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের খননকাজে ব্যয় করা হয়েছে, সেগুলোকে যোগ করে মোট রিজার্ভের পরিমাণ দেখিয়ে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
যে রিজার্ভ এই মুহূর্তে ব্যবহার করা যাবে না, তাকেও রিজার্ভ বলে গণ্য করে মোট রিজার্ভকে বড় করে দেখানোর স্থূলবুদ্ধি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাথায় থাকলেও সাধারণ গণিত জানা কোনো যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষে তা মেনে নেওয়া কঠিন। আইএমএফ এত দিন এ বিষয়ে বলে বলে ক্লান্ত হয়েছে। ঋণ দেওয়ার শর্ত হিসেবে সংস্থাটি যখন রিজার্ভের গণনাপদ্ধতি ঠিক করতে বলেছে, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক তা করবে বলে মেনে নিয়েছে। ফলে বেশি দিন লাগবে না, রিজার্ভের প্রকৃত একটা হিসাব দেখা যাবে।
একইভাবে খেলাপি ঋণ আদায়ে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, খেলাপি হিসেবে গণ্য না হতে ছয়টি কিস্তি পর্যন্ত ছাড়ের পরিবর্তে তিন কিস্তি পর্যন্ত ছাড়ের বিধান চালু, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা, মুদ্রা বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া, বছরে চারবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা ইত্যাদি শর্ত রয়েছে আইএমএফের।
খেলাপি আদায়ে কোম্পানি গঠন করার চল অনেক দেশেই আছে। তবে খেলাপিদের ছাড় দেওয়ার বিধান আছে কম দেশেই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ এখন ২০ শতাংশের বেশি আছে। তা ১০ শতাংশের নিচে নামলে নিশ্চয়ই তা ব্যাংক খাত তথা দেশের মানুষেরই উপকারে আসবে। যদিও ৪ ফেব্রুয়ারি সানেমের অর্থনীতিবিদ সম্মেলনে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, বহু দশক ধরে তিনি দেখেছেন, (আইএমএফের সঙ্গে) কাগজে সই করলেই খেলাপি ঋণ কমে যাবে না। কারণ, এটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক ব্যাপার।
বিদায়ী গভর্নর ফজলে কবির কোন বিবেচনায় বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা চালু করেছিলেন, তিনিই ভালো জানেন। আশার কথা যে বর্তমান গভর্নর বছরে অন্তত দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা দেবেন বলে ইতিমধ্যে জানিয়েছেন। তিনি এ–ও ঘোষণা করেছেন, মুদ্রা বিনিময় হার এবং সুদের হার ধীরে ধীরে হলেও তিনি বাজারের ওপর ছেড়ে দেবেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কাজ যে করতে হবে, তা আইএমএফকে কেন বলতে হবে? বিষয়টা অনেকটা এ রকম: সংস্কারের ফলাফল ভোগ করবেন এ দেশের মানুষ, কিন্তু এ দেশের নীতিনির্ধারকেরা তা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে করবেন না। করবেন আইএমএফের কথায়।
একই বিষয় প্রযোজ্য রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রেও। জিডিপির তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহে বাংলাদেশ গোটা বিশ্বেই বেশ পিছিয়ে। এ হার ১০ শতাংশের কম। রাজস্ব-জিডিপির হার বাড়লে সরকারি ব্যয়ে সরকারেরই সক্ষমতা বাড়বে। এ কথা আইএমএফকে কেন বলতে হবে? এনবিআর তথা সরকারের নিজের কেন এ ব্যাপারে হুঁশ থাকবে না? দেশে একটি আয়কর আইন হবে, বহু দিন ধরে শোনা যাচ্ছে। স্বাধীনতার এত বছরেও দেশে কোনো শুল্ক আইন প্রণয়ন করা হয়নি। তা–ও বলতে হবে আইএমএফকে? কোন বছরে কতটা ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) কিনতে হবে, তা–ও যদি আইএমএফকেই বলে দিতে হয়, তাহলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি দপ্তরের কাজটা কী, এ প্রশ্নও সামনে চলে আসে।
মোটকথা, আইএমএফের ঋণ নিতে গিয়ে বাংলাদেশকে বেশ কিছু সংস্কারমূলক কাজ করতে হবে। যেসব সংস্কারনীতি সিদ্ধান্ত দিয়ে করে ফেলা যায়, সরকার সেগুলো সহজেই করেছে। যেমন জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম আইএমএফের শর্তগুলো ঘোষিত হওয়ার আগেই বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। ফলে এ নিয়ে আইএমএফের শর্তের মধ্যে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা নেই। বলা আছে, আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে মিলিয়ে জ্বালানি তেলের দর নির্ধারণে একটা উপায় বের করতে হবে। গত অক্টোবর-নভেম্বরে যখন আইএমএফের মিশন এসেছিল, তখনই এ নিয়ে আলোচনা হয়। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ আইএমএফের ঋণ অনুমোদনের আগেই এ ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছেন।
ভুলে গেলে চলবে না যে আইএমএফ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে সাড়ে ৩ বছরে। ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে পাওয়া গেছে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ৭০ কোটি ৪০ লাখ ডলারের দ্বিতীয় কিস্তি আসার কথা আগামী নভেম্বরে। অর্থনীতির এই সময়ে রপ্তানি আয়ের ব্যতিক্রম সূচক ছাড়া প্রায় সব সূচকই যখন নেতিবাচক, ব্যবসায়ীরা এমনকি আমদানির জন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে এইটুকু ডলারও কম নয়।
তবে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের পুরোটাই কিন্তু বাজেট সহায়তা আকারে আসবে না। এর মধ্যে ১৪০ কোটি ডলারই রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফান্ডের (আরএসএফ) আওতায়। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে এ তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। এ অর্থ ব্যবহার করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলোতে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকার প্রথম সারিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী যে কার্বন নিঃসরণ, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই তলানিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝড়, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস—এগুলোর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচতে হচ্ছে এ দেশের মানুষকে।
আইএমএফ বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে কেবল ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে জিডিপির ১ দশমিক ৫ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ এখন প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলায় জিডিপির ১ শতাংশের কম ব্যয় করছে। কিন্তু আইএমএফ বলছে, আগামী ১৫ বছরে সরকারকে এ খাতে বরাদ্দ জিডিপির ৩ থেকে ৪ শতাংশে উন্নীত করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য আইএমএফ থেকে নেওয়া ঋণের অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় হবে কি না। ২০১৭ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘জলবায়ু অর্থায়ন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান: প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছিল, রাজনৈতিক প্রভাব বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে। যেখানে ঝুঁকি বেশি, সেখানে বরাদ্দ কম; বরং প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কারণে ‘পছন্দমতো প্রকল্প’ নিয়ে বরাদ্দ বেশি করায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এতে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।
টিআইবি তখন আরও বলেছিল, জলবায়ু তহবিলের নামে যে কাজ হচ্ছে, তা কেবল নামেই হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে তেমন কোনো কাজ হচ্ছে না। তারও আগে, ২০১২ সালে প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, ‘জলবায়ু তহবিল পাওয়া ৬৩ এনজিওর অর্ধেক অনভিজ্ঞ।’ একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি ঋণের অর্থে না হোক, এটা আমরা চাইতেই পারি।
দুর্ভাগ্যজনক যে বাংলাদেশের মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন আর এ বিষয়েও যথাযথভাবে কাজ করতে চাপ দিতে হচ্ছে আইএমএফকে। আইএমএফ না বললে সময়বদ্ধ পরিকল্পনা হবে না, কাজ হবে না—এমন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসে নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে নিজেদেরই জবাবদিহিমূলক অবস্থা তৈরি করতে হবে। নইলে সবই হবে, অর্থও আসবে, কিন্তু বাংলাদেশ কেবল পেছাবেই। যদিও ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে আমরা উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে পরিচিতি পাব।