চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সিংহভাগ পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সিংহভাগ পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে

পণ্য রপ্তানির আড়ালে অর্থ পাচার 

  • লুপডট ফ্যাশনের দাবি, তাদের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ চালান পাঠিয়েছে।

  • কাস্টমস বলছে, অন্য কারও পক্ষে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে রপ্তানির সুযোগ নেই। 

ময়মনসিংহের এক পোশাক কারখানার নাম ব্যবহার করে তৈরি পোশাকের ২২৫ চালান পণ্য বিদেশে পাঠানো হয়েছে। এসব পণ্যের রপ্তানি মূল্য সাড়ে ৬৮ লাখ মার্কিন ডলার বা ৭৫ কোটি টাকা দেশে আসেনি। চালানগুলো গেছে মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (ইউএই) মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে।

ময়মনসিংহের ভালুকার লুপডট ফ্যাশন লিমিটেডের দুটি চালান আটক করার পর এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ রপ্তানিকারক ও রপ্তানিকারকের প্রতিনিধি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। 

জালিয়াতি ধরা পড়ার পর লুপডট ফ্যাশনের প্রতিনিধি লিখিতভাবে জানান, তাঁরা এসব চালান রপ্তানি করেননি। তাঁদের নাম ব্যবহার করে অন্য কেউ এসব চালান পাঠিয়েছে। অন্যদিকে কাস্টমসের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে অন্য কারও পক্ষে এভাবে পণ্য রপ্তানির সুযোগ নেই। রপ্তানিকারক অস্বীকার করার অর্থ, এই রপ্তানি আয় দেশে আসেনি, আসার সম্ভাবনাও নেই। 

জানতে চাইলে কাস্টমসের উপকমিশনার মো. বদরুজ্জামান মুন্সী গত বুধবার বলেন, ‘আমরা প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানি জালিয়াতির বিষয়টি উদ্‌ঘাটন করেছি। চালানগুলোর বিপরীতে দেশে অর্থ আসেনি। তদন্ত দল গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে অপরাধের ধরন অনুযায়ী কাস্টমস অ্যাক্ট, মুদ্রা পাচার ও ফৌজদারি আইনে মামলা হতে পারে।’

জালিয়াতি করে ২২৫টি চালানে সাড়ে ৬৮ লাখ ডলার বা ৭৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি। রপ্তানিকারকের অস্বীকার। এই অর্থ দেশে আসেনি।

  যেভাবে ধরা পড়ল জালিয়াতি

লুপডট ফ্যাশন লিমিটেড অসত্য তথ্য দিয়ে রপ্তানি করছে—এমন অভিযোগে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠানটির সব চালানই শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করে তবেই ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে শতভাগ পরীক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটির দুটি রপ্তানি চালানে ঘোষণার চেয়ে বেশি পরিমাণ তৈরি পোশাক শনাক্ত করা হয়। দুটি চালানের একটিতে শতভাগ পরীক্ষা করেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। তাঁরা দেখতে পান যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) রপ্তানির অপেক্ষায় থাকা চালানটিতে ২৯ হাজার ২৪০ পিস পোশাকের ঘোষণা দেওয়া হলেও পাওয়া গেছে ৫৭ হাজার ৭৪ পিস। লুপডটের পক্ষে এই চালান রপ্তানির কাজ করছিল মাহমুদ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান।  

আবার শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর আরেকটি চালানে ঘোষণার চেয়ে ৫৭ হাজার পিস বেশি পোশাক পায়। লুপডটের পক্ষে এই চালান রপ্তানির কাজ করছিল এনএইচ শিপিং লাইনস। এই চালানের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। 

চালান দুটি ধরা পড়ার পর লুপডট ফ্যাশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এম এ মাসুদ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করেন। তাতে তিনি দাবি করেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার ও কাগজপত্র জালিয়াতি করে ১৯টি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান ২২৫টির বেশি চালান রপ্তানি করেছে। এসব চালানে পাঠানো পণ্যের রপ্তানি মূল্য দেখানো হয় ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ৭৫ কোটি টাকা। 

৪৫০টি খুদে বার্তার পরও সাড়া নেই

রপ্তানিকারক অস্বীকার করলেও কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি চালান রপ্তানির সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুই থেকে তিনটি খুদে বার্তা রপ্তানিকারকের মুঠোফোনে যায়। রপ্তানি চালানের নিবন্ধন, শুল্কায়ন ও রপ্তানি কাজ সম্পন্ন হওয়ার প্রতি ধাপে এই বার্তা পাঠানো হয়। সে হিসেবে ২২৫টি চালানের বিপরীতে পাঠানো খুদে বার্তার সংখ্যা হতে পারে ৪৫০ থেকে ৬৭৫টি। 

যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির সিইও এম এ মাসুদ গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে জানান, বিষয়টি নিয়ে তিনি পরে কথা বলবেন। তবে পরে আবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি। খুদে বার্তারও জবাব দেননি। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানও ফোন ধরেননি।  

ছোট প্রতিষ্ঠানের বড় জালিয়াতি

রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির সব তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। সেসব পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাদের প্রথম চালান পণ্য পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। বুধবার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির নামে ৬৮৬টি চালানে মোট রপ্তানি হয়েছে ২ কোটি ৫১ লাখ ডলার বা ২৪৪ কোটি টাকার পোশাক।  

তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, রপ্তানিকারকের পক্ষে মনোনীত দু-তিনটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান নথিপত্রের কাজ করত। তবে আগস্ট থেকে পাল্টে যেতে থাকে এই চিত্র। প্রতি মাসে গড়ে ৪৮টি চালান রপ্তানি শুরু হয়। কোনো মাসে দিনে রপ্তানি চালানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩। এ সময়ে রপ্তানিকারকের পক্ষে নথিপত্র জমা দেওয়ার কাজ করেছে ২২টি প্রতিষ্ঠান। 

সাধারণত ছোট রপ্তানিকারকের কাজ সামাল দেওয়ার জন্য বড়জোর তিনটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয় কাস্টমস। তাই একটি ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এতগুলো সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠানের কাজ করা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। কাস্টমস কর্মকর্তারাও বলছেন, রপ্তানিকারক ও তাদের মনোনীত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জড়িত না থাকলে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে এভাবে রপ্তানি করা সম্ভব নয়। বিষয়টি জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মতামত জানতে চাইলেও সাড়া দেননি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সিইও এম এ মাসুদ। 

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানি করত। প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যবহার করে যেসব চালান পাঠানো হয়েছে, সেগুলোর গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো।