বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অতি সাধারণ খেজুরের দাম বেঁধে দিয়েছে প্রতি কেজি ১৫০-১৬৫ টাকা।
প্রতি কেজি জাইদি খেজুরের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭০-১৮০ টাকা।
বাংলাদেশের বাজারে বেশি বিক্রি হওয়া খেজুরের জাতের একটি হলো ইরাকের জাইদি খেজুর। দেশের আমদানিকারকেরা এবার প্রতি কেজি জাইদি খেজুর জাহাজভাড়াসহ আমদানি করেছেন ৯৬ টাকার আশপাশের দরে। বাজারে সেই খেজুর বিক্রি হচ্ছে তিন গুণের বেশি দামে।
প্রশ্ন হলো, দাম এতটা কেন বাড়ছে, কোথায় বাড়ছে? বিষয়টি নিয়ে জানতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের আমদানির উপাত্ত, আমদানিকারকদের ব্যয় ও বাজারদর বিশ্লেষণ করা হয়। কয়েকটি চালান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইরাক থেকে আমদানিতে জাহাজভাড়াসহ এক মেট্রিক টন বা এক হাজার কেজি জাইদি খেজুরের (প্যাকেটজাত) দাম পড়েছে ৮০০ মার্কিন ডলার (ডলারপ্রতি ১২০ টাকা ধরে কেজিপ্রতি ৯৬ টাকা)। এই খেজুরের দাম কেজিপ্রতি আড়াই ডলার ধরে (ট্যারিফ ভ্যালু বা শুল্ক আরোপের নির্দিষ্ট মূল্য) শুল্ককর আদায় করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ফলে শুল্ককর পড়েছে কেজিতে প্রায় ১৩০ টাকা।
কয়েকটি চালান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৯৬ টাকা কেজির খেজুরের ওপর ১৩০ টাকা দাঁড়ায় শুল্ককর। খুচরায় দাম হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
এ হিসাবে জাইদি খেজুর আমদানিতে কেজিপ্রতি আনুষ্ঠানিক ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ২২৬ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরিবহন ব্যয়, ব্যাংক ঋণের সুদসহ আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করার পর এক কেজি খেজুরে ব্যয় হয় ২৪০ টাকার মতো। তবে খেজুর আমদানিকারক থেকে পাইকারি, পাইকারি থেকে খুচরা—এভাবে কয়েকদফা হাতবদলে দাম বেড়ে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
খেজুরের দাম কেন এত বেশি বাড়ছে জানতে চাইলে ফ্রেশ ফ্রুট ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোহাম্মদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ খেজুর যে দামে আমদানি করা হয়, শুল্ক দিতে হয় তার চেয়ে বেশি। খেজুর সংরক্ষণ ও পরিবহনের খরচ অন্যান্য পণ্যের তুলনায় বেশি।
এদিকে গতকাল মঙ্গলবার খেজুরের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুরের দাম কেজিপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা এবং জাইদি খেজুরের দাম কেজিপ্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারে অবশ্য দাম এর চেয়ে বেশি। ঢাকায় দেখা গেছে, অতি সাধারণ ও নিম্নমানের খেজুরের দাম ২০০ টাকার আশপাশে ছিল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের স্মারকে বলা হয়েছে, দেশে আমদানি করা বিভিন্ন মানের খেজুরের আমদানি মূল্য, আরোপিত শুল্ক, কর ও আমদানিকারকদের অন্যান্য খরচ বিশ্লেষণ করে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
আমদানি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার ২০২২ সালে খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ককর বাড়িয়ে দেয়। খেজুর আমদানিতে ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট), ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, ৫ শতাংশ অগ্রিম কর ও ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল। মোট করভার প্রায় ৫৯ শতাংশ। সম্প্রতি সরকার রোজা উপলক্ষে ১০ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। এতে কেজিপ্রতি দর ১৩ থেকে ৩৩ টাকা কমার কথা। কিন্তু কমেনি।
এনবিআরের হিসাবে দেখা গেছে, শুল্ককর কমানোর পর গত এক মাসে (৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১০ মার্চ) খেজুর আমদানি করা হয় ৩৮ হাজার ২০৫ টন। মোট আমদানির ২৮ শতাংশই জাইদি খেজুর হিসেবে আমদানি হয়েছে। অবশ্য এবার খোলা খেজুর বা ৩০ কেজির বস্তায় আনা খেজুর আমদানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গত এক মাসে মোট আমদানি হওয়া খেজুরের ৫১ শতাংশই ছিল বস্তায় আনা।
দামি আজওয়া, মরিয়ম, মেডজুল—এ জাতীয় খেজুর আমদানি করা হয়েছে এক শতাংশের কম। আমদানিকারকদের ঘোষণা অনুযায়ী, গত এক মাসে দামি খেজুরের আমদানির পরিমাণ ২৩৯ টন।
সবচেয়ে বেশি আমদানি হওয়া খোলা খেজুরের আমদানিমূল্য পড়েছে প্রতি কেজি গড়ে ৬১ সেন্ট, ডলারপ্রতি দর ১২০ টাকা ধরে দাম পড়ে ৭৩ টাকা। এই জাতীয় খেজুর আমদানিতে ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজিতে শুল্ককর দিয়েছেন ৫২ টাকা। এ হিসাবে আমদানিতে খরচ পড়ে ১২৫ টাকা, যা খালাসের পর ১৩০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। এই খেজুর পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৫০ টাকায়। তবে শহরে খুচরা দোকানে এসব খেজুর খুব একটা দেখা যায়নি।
আমদানিকারকেরা জানান, গ্রামাঞ্চলে এই খেজুর বেশি চলে। বিক্রেতারা ছোট প্যাকেটে ভরে খোলা খেজুর বিক্রি করেন।
বাজারে কেজিপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হওয়া আজওয়া, মরিয়ম, মেডজুল জাতীয় খেজুরের আমদানিমূল্য পড়েছে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। দামি খেজুরে কেজিপ্রতি করভার ২০০ টাকার মতো। এ হিসাবে বন্দর থেকে খালাসের সময় প্রতি কেজিতে খরচ পড়ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। খুচরায় অবশ্য দাম দ্বিগুণ।
চট্টগ্রামের আছদগঞ্জের খেজুর আমদানিকারক ফারুক ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, খেজুরের মূল্যবৃদ্ধির বড় কারণ কিন্তু শুল্ককর বৃদ্ধি। গরিব মানুষেরা যে খেজুর খান, সেটিতেও এখন কেজিপ্রতি কর দিতে হয় ৫২ টাকা।