সঞ্চয়পত্র ও বন্ডে বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন কিছু সুবিধা নিয়ে এসেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। স্থানীয় বিনিয়োগকারী এবং প্রবাসী বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীরা এ সুবিধা ভোগ করবেন।
কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে পারছিল না সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের অবশ্য চাওয়া ছিল কমসংখ্যক মানুষ যেন সঞ্চয়পত্রের দিকে আকৃষ্ট হন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) চায় সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের জন্য সরকারকে প্রতিবছর যে সুদ গুনতে হয়, তা কমে আসুক।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির প্রবণতা বলছে, আগেরবারের মতো এবারও তা হবে নেতিবাচক। অর্থাৎ নিট বিক্রির তুলনায় মানুষের সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রবণতা বেশি।
নতুন সুবিধায় তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র ও পরিবার সঞ্চয়পত্রের মূল বিনিয়োগ করা অর্থের স্বয়ংক্রিয় পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে মূল অর্থের স্বয়ংক্রিয় পুনর্বিনিয়োগ তো হবেই, বিনিয়োগকারীরা ত্রৈমাসিকের পরিবর্তে মুনাফা পাবেন মাসিক ভিত্তিতে। পেনশনাররা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে এলেও সাবেক আইআরডি সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম কোনো সিদ্ধান্ত না দিয়ে প্রস্তাব আটকে রেখেছিলেন।
এ ছাড়া পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের মেয়াদি হিসাবের সুবিধাটা আরেকটু বেশি। এ দুটিতে মুনাফাসহ মূল বিনিয়োগ করা অর্থেরও পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে নতুন করে।
এদিকে সঞ্চয়পণ্যের মধ্যে তিন ধরনের বন্ড রয়েছে। এর মধ্যে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১ মেয়াদে বিনিয়োগ ও ২ মেয়াদে পুনর্বিনিয়োগ করা যাবে এ অর্থ। আর ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে ১ মেয়াদে বিনিয়োগ ও ৪ মেয়াদে পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে।
জাতীয় সঞ্চয় কর্মসূচিগুলোতে স্বয়ংক্রিয় পুনর্বিনিয়োগের ক্ষেত্রে পুনর্বিনিয়োগের তারিখ থেকে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা প্রযোজ্য হবে।
বিদেশি মালিকানাধীন শিপিং বা এয়ার ওয়েজ কোম্পানির বিদেশস্থ অফিসে চাকরিরত অনিবাসী বাংলাদেশি নাবিক (মেরিনার), পাইলট ও কেবিন ক্রুদের জন্য ওয়েজ আর্নার বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল আগের সরকার। নতুন সরকার আবার তা চালু করল। শুধু তা-ই নয়, এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমাও রাখা হয়নি। অর্থাৎ যত খুশি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করা যাবে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সচিব আবদুর রহমান খান বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আমরা সিদ্ধান্তটি নিলাম। আশা করছি বিনিয়োগকারীরা ইতিবাচক সাড়া দেবেন।’ গতকাল রোববার এ বিষয়ে আইআরডি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যা আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
নাবিকদের জন্য অযৌক্তিকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল
সরল সুদে মুনাফা দেওয়ার ভিত্তিতে দেশে ১৯৮১ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড চালু করা হয়। ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিধি ১৯৮১ (সংশোধিত ২৩ মে ২০১৫) অনুযায়ী এ বন্ডে যেকোনো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। কোভিডে-১৯-এর প্রকোপ চলাকালীন ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর আইআরডি এক প্রজ্ঞাপনে নির্ধারণ করে দেয় যে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের সমন্বিত বিনিয়োগসীমা এক কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হবে।
তবে ১৭ মাসের মাথায় ২০২২ সালের ৪ এপ্রিল ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের ঊর্ধ্বসীমা উঠিয়ে নেওয়া হয়। ফলে এ দুই বন্ডে যেকোনো পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করা যাচ্ছিল। তবে বহাল থেকে যায় ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিনিয়োগসীমা। এ বন্ডের অর্থ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগের সুযোগও বন্ধে করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএমওএ) সম্প্রতি আইআরডিতে গিয়ে বৈঠক করে সুযোগটি পুনর্বহালের দাবি জানায়। বিএমএমওএ যুক্তি দিয়ে বলে, এটি অযৌক্তিকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। কারণ, পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা অবসরোত্তর কোনো সুবিধা নাবিকদের নেই। এই পেশাজীবীর সংখ্যা এখন ১২ হাজারের বেশি। বাংলাদেশি একজন মেরিন কর্মকর্তা যখন বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে অবস্থান করেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তখন তিনি ওই দেশের আওতায় থাকেন। সাধারণত ৪ থেকে ৯ মাসের চুক্তি হয় তাঁদের। চাকরির পূর্ণ মেয়াদকালে তাঁর পক্ষে নির্দিষ্ট কোনো দেশে অবস্থানের প্রমাণ দেখানো সম্ভব নয়।
বিএমএমওএ বলেছে, জাহাজে যোগ দেওয়া থেকে শুরু করে জাহাজ থেকে নামা পর্যন্ত সংরক্ষিত সব তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে বৈধ দলিল এবং বিশ্বের সব দেশে তা স্বীকৃত। আর ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিধি ১৯৮১ (সংশোধিত ২০১৫) অনুযায়ী ওয়েজ আর্নার্সের সংজ্ঞা ও বন্ড কেনার যোগ্যতা অনুযায়ীই নাবিকেরা এই বন্ড কিনতে পারেন।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দুই মাস আগে আইআরডি সচিবকে এক চিঠিতে বলেছিল, প্রবাসী আয় প্রবাহের পাশাপাশি প্রবাসীদের বিনিয়োগ বাড়াতে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা তুলে নেওয়া দরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস, এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও তফসিলি ব্যাংকের বিদেশি ও অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখায় এসব বন্ড কেনা যায়। এ বন্ডের মুনাফা আয়করমুক্ত। আবার বন্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার সুযোগও আছে। এ ছাড়া বন্ড কিনতে ফরেন কারেন্সি বা বৈদেশিক মুদ্রায় (এফসি) হিসাব থাকারও বাধ্যবাধকতা নেই। এ বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী (ওয়েজ আর্নার) নিজে। ওয়েজ আর্নার তাঁর মনোনীত ব্যক্তির নামেও এ বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারেন। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত সরকারের কর্মচারীরাও বিনিয়োগ করতে পারেন ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে। এতে বিনিয়োগ করলে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত মৃত্যুঝুঁকির সুবিধা রয়েছে।
বিএমএমওএর সহসভাপতি গোলাম মহিউদ্দিন কাদ্রী বলেন, ‘ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগের সুযোগ চেয়ে কয়েক বছর ধরে আমরা দাবি জানিয়ে আসছিলাম। সরকারের নতুন উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।’