আমরা প্রতিনিয়ত যারা বাজার করি, বিশেষ করে কোনো উপলক্ষে যখন বাজার করা হয়, তখন সাধারণত ফর্দ বা তালিকা তৈরি করে নিয়ে যাই। ফর্দ ছাড়া বাজারে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু কিনতে ভুলে যাই। তেমনি প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন তৈরিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আমরা গোছাতে পারি না। সে জন্য আয়কর রিটার্ন তৈরির ক্ষেত্রে সবাইকে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে, যাতে পরে কোনো সমস্যা বা জটিলতার মুখে পড়তে না হয়। কারণ, একেবারে শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্রের কথা মনে না–ও থাকতে পারে। তাই সব কাগজপত্র আগে থেকেই গোছগাছ করে রাখা উচিত। এ ছাড়া শেষ দিকে সংশ্লিষ্ট সবাই মোটামুটি ব্যস্ততার মধ্যেই থাকেন বলা যায়। এসব মিলিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বাদ পড়তে পারে। এতে আয়কর রিটার্ন তৈরি ত্রুটিপূর্ণ হতে পারে।
আমরা জানি, প্রতিবছর ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিশ্রেণির করদাতারা আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারেন। এ বছর রিটার্ন জমার সময় এরই মধ্যে একমাস বাড়ানো হয়েছে। সেই হিসাবে রিটার্ন জমার শেষ তারিখ ৩১ ডিসেম্বর।
আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার পর ফাইল আবার উন্মোচন করা হতে পারে। আয়কর ফাইলে ত্রুটি থাকলে তখন কিন্তু বিপদের আশঙ্কা থেকে যাবে। সে জন্য শুরু থেকেই সতর্কতার সঙ্গে আয়কর রিটার্ন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করুন, কাগজপত্র প্রস্তুত রাখুন।
এখন আসা যাক আপনার করণীয় নির্ধারণের বিষয়ে। প্রথমেই আয়কর রিটার্ন তৈরিতে সাধারণত কী কী কাগজপত্র লাগে, সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে ফেলুন। সে অনুযায়ী কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিন। এভাবে রিটার্ন তৈরি করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তাতে ঝক্কিঝামেলা এড়াতে পারবেন। আয়কর বিষয়ে গত ২৫ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে আমি একটি ফর্দ বা তালিকা এখানে উপস্থাপন করলাম। এই তালিকা আপনাদের, মানে করদাতাদের উপকারে আসতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সংগ্রহ করা কাগজপত্র ২০২৪-২৫ কর বছরের জন্য ১ জুলাই ২০২৩ থেকে ৩০ জুন ২০২৪ তারিখের মধ্যে আপনার দ্বারা সংঘটিত ও আপনার সম্পৃক্ততা রয়েছে, এমন সব অর্থনৈতিক কার্যক্রমের দলিল কি না, সেটি বিশেষভাবে লক্ষ করবেন। যা–ই হোক, আয়কর রিটার্ন তৈরির জন্য কাগজপত্রের যে ফর্দ বা তালিকা প্রস্তুত করবেন, সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো।
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের জন্য যা যা দরকার
আয়ের বিবরণী
১. বেতন খাতে আয় (ফটোকপি সংযুক্ত করবেন)।
২. গৃহ সম্পত্তি খাতের আয়:
ক. গৃহের তলাভিত্তিক ফ্লোর স্পেস ও ভাড়া (ভাড়ার চুক্তিপত্র)।
খ. পৌরকরের পরিমাণ (পৌরকর প্রদানের রসিদ)।
গ. বন্ধকি ঋণের ওপর সুদ (ব্যাংকের ইস্যুকৃত বিবরণী বা সার্টিফিকেট)।
ঘ. বাসস্থান খালি থাকলে তার সময়কাল (উপ-কর কমিশনারকে জানানো হলে পত্রের কপি)।
৩. কৃষি আয়:
ক. কৃষিজমির পরিমাণ।
খ. ফলনকৃত শস্যের পরিমাণ।
গ. বাজারমূল্য।
৪. ব্যবসা বা পেশা খাতে আয় (স্থিতিপত্র ও আয়-ব্যয়ের বিবরণী, যদি থাকে)
৫. মূলধনি লাভ:
ক. মূলধনি সম্পদের বিক্রয়মূল্য (বিক্রির চুক্তিপত্র ও বিক্রির রসিদ বা দলিল)।
খ. বিক্রীত সম্পদের ক্রয়মূল্য (ক্রয়ের দলিল অথবা প্রমাণপত্র)।
গ. আনুষঙ্গিক মূলধনি ব্যয় (ক্রয় ও আনুষঙ্গিক মূলধনি ব্যয়ের প্রমাণপত্র)।
৬. আর্থিক পরিসম্পদ থেকে আয়:
ক. লভ্যাংশ।
খ. ব্যাংকের সুদ/মুনাফা।
গ. সঞ্চয়পত্রের সুদ।
ঘ. স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্টস (এফডিআর)।
৭. অন্যান্য উৎস খাতে আয়:
অন্যান্য উৎসের আয়ের সপক্ষে প্রমাণপত্র
কর রেয়াতের জন্য বিনিয়োগ:
ক. জীবন বীমার প্রদত্ত কিস্তি (প্রিমিয়ামের রসিদ)।
খ. ভবিষ্যতে প্রাপ্য বার্ষিক ভাতাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে চাঁদা (উপযুক্ত কর্মকর্তা কর্তৃক ইস্যুকৃত সার্টিফিকেট)।
গ. ভবিষ্য তহবিল আইন, ১৯২৫ অনুযায়ী প্রযোজ্য ভবিষ্য তহবিলে প্রদত্ত চাঁদা (সার্টিফিকেটের ফটোকপি)।
ঘ. স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিলে স্বীয় ও নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত চাঁদা (সার্টিফিকেটের ফটোকপি)।
ঙ. অনুমোদিত বয়সজনিত তহবিলে প্রদত্ত চাঁদা (নিয়োগকর্তার সার্টিফিকেট)।
চ. অনুমোদিত ঋণপত্র বা ডিবেঞ্চার স্টক, স্টক বা শেয়ারে বিনিয়োগ (বিনিয়োগের প্রমাণপত্র)।
ছ. ডিপোজিট পেনশন স্কিমে (ডিপিএস) প্রদত্ত চাঁদা (ব্যাংকের সার্টিফিকেট সর্বোচ্চ ১,২০,০০০ টাকার বিনিয়োগ অনুমোদনযোগ্য)।
জ. কল্যাণ তহবিলে প্রদত্ত চাঁদা এবং গোষ্ঠী বিমা স্কিমের অধীন প্রদত্ত কিস্তি (নিয়োগকর্তার সার্টিফিকেট)।
ঝ. জাকাত তহবিলে প্রদত্ত চাঁদা (প্রমাণপত্র)।
ঞ. অন্যান্য, যদি থাকে (বিবরণ দিন ও প্রমাণপত্র)।
রিটার্ন তৈরি করে স্বাক্ষর এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আয়কর রিটার্নের সঙ্গে সংযুক্ত করার পর রিটার্নসহ কাগজপত্রের ফটোকপি করে ফাইলে সংরক্ষণ করুন। তাহলে পরবর্তী অর্থবছরের আয়কর রিটার্ন তৈরি করা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যাবে এবং সময়ও বাঁচবে। যদি কোনো কারণে আয়কর ফাইল অডিটে নির্বাচিত হয় বা কোনো তদন্ত করা হয়, সে ক্ষেত্রেও পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনা করতে সুবিধা হবে আপনার।
লেখক: আয়কর আইনজীবী এবং নির্বাহী পরিচালক, গোল্ডেন বাংলাদেশ।