সঞ্চয়ের জন্য এখনো সাধারণ মানুষ বেশি আস্থা রাখেন ব্যাংকের প্রতি। সুদ কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করলে ব্যাংক থেকে হাতে তেমন কিছুই থাকে না। তাহলে বিনিয়োগের বিকল্প পথ কী কী। এবারের মূল আয়োজন এ নিয়েই।
শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীদের কথা আলাদা। নিজেদের টাকা তো আছেই, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজে ঋণও নিতে পারেন তাঁরা। নিয়ে ব্যবসা করতে পারেন, কারখানাও গড়তে পারেন। কিন্তু স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ কোথায় যাবেন, কিসে বিনিয়োগ করবেন—এ নিয়ে ভালোই বিপত্তি আছে। অনেকে বুঝতে পারেন না, বিভ্রান্তিতে থাকেন।
কারণও আছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রও যে বেশি নেই! বিশেষ করে যাঁরা ঝুঁকি নিতে চান না বা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই, তাঁদের জন্য সবার আগে আসে সঞ্চয়পত্রের নাম। বলতেই হবে, বাজারে প্রচলিত বিনিয়োগের যেকোনো বিকল্পের চেয়ে সঞ্চয়পত্রই উত্তম।
কিন্তু সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের একটা উচ্চসীমা আছে। একক নামে ৫০ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা যায় না। যৌথ নামে অবশ্য এক কোটি টাকা পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র কেনা যায়। কিন্তু দেড় কোটি, দুই কোটি, তিন কোটি টাকা থাকলে করণীয় কী? টাকা কি বালিশের তলায় রাখতে হবে? একদমই না। নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে বিকল্প। তবে ভুল পথে পা বাড়ানো যাবে না। উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে অনেকেই ওত পেতে আছেন। অনেকেই ফাঁদ পেতে রেখেছে, পা দিলেই ধরা। তাহলে উপায়?
একসময় সঞ্চয়পত্র বিক্রির জন্য দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিত জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর। কয়েক বছর ধরেই দপ্তরটি আর সে ধরনের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে না। মানুষ এমনিতেই জেনে গেছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের সঞ্চয় কর্মসূচিগুলোর (স্কিম) মধ্যে চারটিই এখন প্রধান। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র। সবচেয়ে বেশি মুনাফা পাওয়া যায় পেনশনার সঞ্চয়পত্র থেকে। সুদের হার মেয়াদ শেষে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। বেশি মুনাফা পাওয়া গেলেও এই সঞ্চয়পত্র সবাই কিনতে পারেন না। এটি কিনতে পারেন শুধু অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা।
পরিবার সঞ্চয়পত্রে পাঁচ বছর মেয়াদ শেষে মুনাফা পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র তিন বছর মেয়াদি। এই সঞ্চয়পত্রে মেয়াদ শেষে সুদের হার ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের অন্যতম বিকল্প হতে পারে ব্যাংক। দেশের ব্যাংকগুলোতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা যায়। স্থায়ী আমানতও (এফডিআর) করা যায়। আবার মাসে মাসেও টাকা রাখা যায়। সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকই হতে পারে এ বিনিয়োগের জায়গা। বুঝেশুনে, খোঁজখবর নিয়ে এবং গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে এগোলে এমনকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও (লিজিং) কেউ টাকা রাখতে পারেন। তাঁরা সুদ বেশি দেয়। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সুশাসন কম থাকা বা ঝুঁকিপূর্ণ কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগের চিন্তা মাথায় আনা যাবে না।
তবে ব্যাংকে টাকা রাখলে একসময় যে পাঁচ থেকে ছয় বছরেই দ্বিগুণ হতো, সেই দিন এখন আর নেই। গত বছরের এপ্রিল থেকে সুদের হার নয়-ছয়, অর্থাৎ ঋণের সুদ ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদ ৬ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার পর এফডিআরে টাকা রাখার পর দ্বিগুণ হওয়ার সময়ও বেড়েছে। তবে এখনো কোনো কোনো ব্যাংকে ৭ থেকে ১০ বছরে টাকা দ্বিগুণ হয়। কোনো কোনো ব্যাংক সময় নেয় ১২ বছর।
ব্যাংকে এফডিআর রাখলে প্রথম দিন চুক্তির সময় যে সুদের হারের কথা ব্যাংক বলে থাকে, সাধারণত তার হেরফের হয় না। প্রায় সব ব্যাংকেই এফডিআর রাখার সুযোগ রয়েছে। যদিও সরকারি ব্যাংকগুলো এখন আর দীর্ঘমেয়াদি এফডিআর নিচ্ছে না। যেমন জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক কমপক্ষে তিন মাসের জন্য এফডিআর নেয়। দুই বছরের বেশি সময়ের জন্য নেয় না। সুদের হারও ৫ থেকে ৬ শতাংশ। রূপালী ব্যাংক অবশ্য ৩ বছরের জন্যও টাকা নেয় ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশ সুদে।
খেয়াল রাখতে হবে, প্রতি মাসে টাকা রাখার ক্ষেত্রে দুটি বিকল্প থাকে। একটিতে সুদের হার পুরোপুরি নির্ধারিত। অন্যটিতে পরিবর্তনের এখতিয়ার রাখে ব্যাংক। টাকা রাখতে গেলে বেশি কিছু কাগজপত্রেরও দরকার হয় না। আবেদনপত্র পূরণ করে দুই কপি পাসপোর্ট আকারের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের ফটোকপি যুক্ত করে দিলে এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে ব্যাংক কাজটি করে দেয়।
ব্যাংকে এফডিআরের বড় সুবিধা হচ্ছে, জমা টাকার বিপরীতে জরুরি প্রয়োজনে চাইলে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নেওয়া যায়।
একসময় ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক (সাধারণ হিসাব), ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক (মেয়াদি হিসাব) এবং ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক (বোনাস হিসাব)—এ তিন ধরনের হিসাব ছিল, যেখানে মানুষ টাকা রাখতে পারতেন। ১৯৯২ সাল থেকে বোনাস হিসাবটি বন্ধ রয়েছে। বাকি দুটি চালু।
টাকা জমানোর ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরোনো মাধ্যম ডাকঘর। এটি চালু হয় ব্রিটিশ সরকারের আমলে ১৮৭২ সালে। ডাকহরকরাদের কিছুটা সুবিধা দিতে এই কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। বাংলাদেশে এ কর্মসূচি চালু হয় ১৯৭৪ সালে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা বৃদ্ধির স্বার্থে। কর্মসূচি পরিচালিত করতে ১৯৮১ সালে করা হয় ‘ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বিধি’। তবে নাম ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বিধি হলেও বাস্তবে ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংক বলতে কোনো ব্যাংক নেই দেশে। আবার পুরো বিষয়টি দেখভালও করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, ডাক অধিদপ্তর নয়।
এক বছর আগে ডাকঘর সঞ্চয় কর্মসূচির সাধারণ হিসাবের ক্ষেত্রে সুদের হার ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর ৩ বছর মেয়াদি হিসাবের সুদের হার ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ হিসাবের সুদের হার কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং মেয়াদি হিসাবের সুদের হার ৬ শতাংশ করা হলে দেশজুড়ে সাধারণ সঞ্চয়কারীরা ক্ষুব্ধ হন। পরে সরকার সুদের হার আগেরটাই বহাল রাখে।
তবে সুদের হার যেহেতু সরকার কমাতে চেয়েও পারেনি, তিন মাসের মাথায় গত বছরের জুনে বিনিয়োগের উচ্চসীমা দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে একক নামে ১০ লাখ বা যুগ্ম নামে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগসীমা বেঁধে দিয়েছে। এখন এই সীমাই রয়েছে। অথচ সাধারণ ও মেয়াদি উভয় হিসাবেই টাকা রাখা যেত একক নামে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ বা যুগ্ম নামে সর্বোচ্চ ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত।
হিসাব দুটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব শ্রেণি-পেশার বাংলাদেশি নাগরিকই এতে টাকা রাখতে পারেন। উভয় হিসাবেই নমিনি নিয়োগ করা যায়, পরিবর্তন করা যায় আবার বাতিলও করা যায়। অন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, সাধারণ হিসাবে এক মাসেও সুদ তোলা যায়। আর মেয়াদি হিসাবে ছয় মাস পরপর সুদ তোলা যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে পুনর্বিনিয়োগ করার সুবিধাও রয়েছে এতে।
ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্রের সঙ্গে শেয়ারবাজারের একটা সম্পর্ক আছে সব সময়ই। ২০১০ সালের শেয়ারবাজার ধসের আগে অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন। অনেকে সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েও তখন বিনিয়োগ করেন শেয়ারবাজারে। কয়েক বছরের ব্যবধানেই দেখা গেছে, শেয়ারবাজারের বিনিয়োগ গুটিয়ে মানুষ সঞ্চয়পত্র কিনছেন।
যেকোনো বিনিয়োগের তুলনায় শেয়ারবাজার বেশি লাভ দেয়। তবে অবশ্যই এ বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে এবং বুঝেশুনে করতে হবে। আর ভালো কোম্পানি সাধারণত বছর শেষে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ দেয়ই। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো হচ্ছে কোম্পানির মৌল ভিত্তি, শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস), মূল্য আয় (পিই) অনুপাত, নিট সম্পদ মূল্য (এনএভি), লভ্যাংশের গড়, কোম্পানির ঋণ এবং দেশের অর্থনৈতিক, কখনো কখনো রাজনৈতিক অবস্থা।
কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত যত কম, বিনিয়োগের জন্য তা তত ভালো। সাধারণত ১০ থেকে ১৫ পিই অনুপাত হলে ভালো। এর বেশি হলে একটু ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কোম্পানির আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। কারণ, আয় বাড়লে পিই অনুপাত কমে যাবে।
বিনিয়োগের আগে কোম্পানির রিজার্ভ ও সঞ্চিতির পরিমাণও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। সঞ্চিতি নেতিবাচক হলে বুঝতে হবে পুঞ্জীভূত লোকসান রয়েছে। ফলে লভ্যাংশ হিসেবে না-ও দিতে পারে। বিনিয়োগে এনএভি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
কোনো কোম্পানির প্রতি শেয়ারের বিপরীতে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তা-ই হচ্ছে এনএভি। যেমন কোনো কোম্পানির নিট সম্পদ যদি হয় এক লাখ টাকা, আর মোট শেয়ার যদি হয় ১০০টি, তাহলে এনএভি হবে এক হাজার টাকা। যে কোম্পানির এনএভি যত বেশি, সে কোম্পানি তত ভালো।
সব বাদ দিয়ে কেউ যদি মনে করেন টাকাই মাটি, মাটিই টাকা। সে ক্ষেত্রে তিনি জমি কিনে রাখতে পারেন। বছর ঘুরলে সাধারণত জমির দাম বাড়ে। অনেক সময় বাড়েও না। সুতরাং বুঝেই কিনতে হবে। নিচু জমি কিনে মাটি ভরাট করেও অনেকে বেশি দামে তা বিক্রি করেন। তবে জমি কেনার আগে সাবধান। দলিল পরীক্ষা করুন, বারবার যাচাই-বাছাই করুন। এক জমি কয়েকজনের কাছে বিক্রির উদাহরণ এ দেশেই আছে।