প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের মুনাফার হার প্রায় অর্ধেক কমিয়ে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। দুটি বন্ডেই এত দিন চার স্তরে মুনাফা দেওয়া হয়েছে। এখন স্তর করা হয়েছে তিনটি।
আগে বন্ড দুটিতে সর্বোচ্চ এক কোটি টাকার সমমূল্যের ডলার বিনিয়োগ করা গেলেও এখন সীমাহীন বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) সোমবার এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বন্ড দুটি জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের আর্থিক পণ্য। কিন্তু সূত্রগুলো জানায়, অধিদপ্তর এ বিষয়ে কিছুই জানে না। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে এ প্রজ্ঞাপন আপলোডও করা হয়নি। আবার আইআরডি প্রজ্ঞাপন জারি করলেও এ নির্দেশনা মূলত অর্থ বিভাগ থেকে এসেছে বলে জানা গেছে।
ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে এত দিন ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যাবে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা। একইভাবে দ্বিতীয় বছর শেষে ৭ শতাংশের বদলে ৫ শতাংশ এবং তৃতীয় বছর শেষে ৭ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ১ লাখ ১ থেকে ৫ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করে প্রথম বছর শেষে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৪ শতাংশ ও তৃতীয় বছর শেষে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে। আর ৫ লাখ ১ ডলার থেকে তার বেশি অর্থ বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে ২ দশমিক ৫ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৩ শতাংশ ও ৩ বছর শেষে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে।
এদিকে ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে ১ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে ৪ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৬ শতাংশের বদলে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ আর তৃতীয় বছর শেষে ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে।
এ ছাড়া ১ লাখ ১ থেকে ৫ লাখ ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে ৫ দশমিক ৫ থেকে ৩ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৬ শতাংশের বদলে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ ও মেয়াদান্তে ৬ শতাংশের বদলে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে। ৫ লাখ ১ থেকে তার বেশি ডলারের বিনিয়োগের বিপরীতে প্রথম বছর শেষে ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে ২ শতাংশ, দ্বিতীয় বছর শেষে ৬ শতাংশের বদলে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৩ বছর শেষে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের বদলে ৩ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যাবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের চালু করা আরও একটি বন্ড রয়েছে। এর নাম ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড। এ বন্ডের মুনাফার হার ও স্তর কমানোর কথা কিছুই নেই নতুন প্রজ্ঞাপনে। এ বন্ডে ৫ বছর শেষে মুনাফার হার ১২ শতাংশ।
বন্ডে বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া, নবায়নের সুবিধা তুলে নেওয়া ও করোনার ধাক্কায় বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগ কমে আসছিল। বিষয়টি সম্প্রতি সরকারের নজরে এসেছে। সরকার ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের প্রতি জনের বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা এক কোটি টাকা বেঁধে দেয়। আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ নবায়নের সুবিধাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে একশ্রেণির প্রবাসী ব্যবসায়ী অসন্তুষ্ট ছিলেন বলে আইআরডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে এসব বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগের স্থিতি ছিল ১২ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা, যা ২০২০ সালের জুনে ১৩ হাজার ৯০৩ কোটি, ২০২১ সালের জুনে ১৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা হয়। কিন্তু সীমা বেঁধে দেওয়ার পর স্থিতি কমতে থাকে।
দেশে ১৯৮৮ সালে পাঁচ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট বন্ড এবং ২০০২ সালে তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড চালু করা হয়।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিক্রি হয় ১ হাজার ৯০২ কোটি টাকার, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৬৬ কোটি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৪১ কোটি ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা হয়। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি ৭ মাসে বিক্রি হয়েছে ৫৫৮ কোটি টাকার বন্ড। এ সময় বন্ড ভাঙানো হয় ৫২৫ কোটি টাকার।
ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকা ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন প্রবাসীরা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) বিনিয়োগ হয় মাত্র ৪ কোটি টাকা। আর এ সময় ৫৩ কোটি টাকার বন্ড নগদায়ন বা ভাঙানো হয়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিক্রি হয় ২৪৩ কোটি টাকার। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৪৪ কোটি টাকার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৭১ কোটি টাকার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪৯ কোটি টাকার ও ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৮০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিক্রি হয় মাত্র ২৮ কোটি টাকার। একই সময়ে প্রবাসীরা ৬০৩ কোটি টাকার ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড নগদায়ন করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক, এক্সচেঞ্জ হাউস, এক্সচেঞ্জ কোম্পানি ও তফসিলি ব্যাংকের বিদেশি ও অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখায় এসব বন্ড কেনা যায়। এসব বন্ডের মুনাফা আয়করমুক্ত। আবার বন্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার সুযোগও আছে। এ ছাড়া বন্ড কিনতে ফরেন কারেন্সি বা বৈদেশিক মুদ্রায় (এফসি) হিসাব থাকারও বাধ্যবাধকতা নেই।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোছা. মাকছুদা খাতুনকে মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে অধিদপ্তরের পরিচালক মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীদের বিনিয়োগের জন্য তিনটি বন্ড থাকলেও দুটিতে মুনাফার হার কমিয়ে বিনিয়োগসীমা তুলে নেওয়া হয়েছে। আরেকটির মুনাফার হার ও বিনিয়োগসীমা আগের মতোই আছে।