শুল্ক–কর অব্যাহতির কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো রাজস্ব আদায় করা যায় না বলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক গবেষণার হিসাবে দেখা গেছে। এই পরিমাণ অব্যাহতিপ্রাপ্ত শুল্ক–কর আদায় করা গেলে রাজস্ব আদায় প্রায় ৮০ শতাংশের মতো বেড়ে যেত।
এনবিআরের আরেকটি গবেষণা বলছে, স্বল্প করহার, কর অব্যাহতি এবং কর অবকাশ সুবিধাগুলোর কারণে দেশে কর–জিডিপির বর্তমান অনুপাত সম্ভাব্য প্রকৃত অনুপাতের তুলনায় ২ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হচ্ছে।
এ ছাড়া আমদানি পর্যায়ে শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক এবং নানা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেয় এনবিআর। চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের বাজেটে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞেরা বলেন, সব কর অব্যাহতি অবশ্য যে খারাপ, তা নয়। কিছু কিছু খাতে কর অব্যাহতির কারণে ওই সব খাত শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে গেছে এবং অর্থনীতিতে অবদানও রাখছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসেবে কর ছাড়ের পরিমাণ কমাতে বলেছে। বাংলাদেশ এই শর্ত পালনে রাজিও হয়েছে।
বাংলাদেশে কারা, কখন, কীভাবে কর ছাড় পায়—এর সুস্পষ্ট নীতিমালা নেই। কারণ, কর ছাড়গুলো বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়েছে। কখনো কখনো অর্থবছরের মাঝখানে প্রজ্ঞাপন দিয়েও কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এসব সুবিধা দেওয়ার ফলে লাভ কতটা হয়েছে—এর বিস্তারিত কোনো গবেষণা করেনি এনবিআর। তাই কর ছাড়ের সব তথ্য এক জায়গায় সংরক্ষিত নেই।
এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর অব্যাহতি কমাতে হবে। তবে কোন কোন খাতে কর অব্যাহতি কমানো হবে, তা নিয়ে একটি পর্যালোচনা করা উচিত। কারণ, সব কর অব্যাহতি খারাপ নয়। শিল্পায়নের স্বার্থেই কিছু কর অব্যাহতি দেওয়া হয়।’
আয়কর খাতে মোটাদাগে মোট আটটি খাত কর ছাড় পায়। এবার দেখা যাক, আয়কর খাতে কোথায় কর ছাড় দেওয়া হয়েছে।
রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) কোনো শিল্পকারখানা স্থাপন করলে এলাকাভেদে ১০ বছর পর্যন্ত ২৫ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুবিধা মেলে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক এবং সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) প্রকল্পেও কর অবকাশ সুবিধা আছে।
শিল্প খাতের পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ, জ্বালানি, যোগাযোগ এবং অন্যান্য অত্যাবশকীয় ৩৯ ধরনের ভৌত অবকাঠামো খাতে নির্মাণের পর ১০ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন হারে কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎ খাতেও বড় ধরনের কর অব্যাহতি সুবিধা আছে। যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়, বিদেশি ঋণের সুদ, শেয়ার হস্তান্তরের ফলে মূলধনি মুনাফার ওপর অর্জিত আয়, রয়্যালটি, টেকনিক্যাল নো–হাউ ফি, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ফি এবং বিদেশি কর্মীদের আয়ের ওপর নির্দিষ্ট হারে কর ছাড় আছে।
২২টি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২০০৮ সালেলর ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কর অবকাশ সুবিধা দেওয়া আছে।
রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের জন্য সাড়ে ২৭ শতাংশ করপোরেট করের পরিবর্তে ১২ শতাংশ হারে করসুবিধা আছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা হলে এই হার ১০ শতাংশ।
হস্তশিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত বার্ষিক টার্নওভারের ওপর ২০২৪ সালের ৩০ জুন করমুক্ত আয়ের সুবিধা দেওয়া আছে। এ ছাড়া স্বল্পোন্নত এলাকায় হস্তশিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা কারখানা করলে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কর ছাড় মেলে।
কৃষি যন্ত্রপাতি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক উৎপাদন থেকে প্রথম ১০ বছর পুরোপুরি আয়করমুক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পাটজাত পণ্য উৎপাদন করলে ওই প্রতিষ্ঠানের করহার ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা আছে। রাইসব্রান তেল উৎপাদনশিল্প, ফল–শাকসবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন, শিশুখাদ্য উৎপাদন হতে অর্জিত আয়ের ওপর এলাকাভেদে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রেয়াতি হারে কর অব্যাহতির সুবিধা আছে।
কোনো প্রতিষ্ঠানে মোট কর্মীর ১০ শতাংশ বা ২৫ জনের বেশি তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে নিয়োগ দিলে ওই প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত আয়করের ওপর ৫ শতাংশ বা তৃতীয় লিঙ্গের কর্মীদের দেওয়া বেতন–ভাতার ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কর রেয়াতির সুবিধা পায়। একই নিয়মে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে নিয়োগ দিলেও একই হারে কর–সুবিধা মেলে।
বাংলাদেশে উৎপাদিত অটোমোবাইল (থ্রি–হুইলার ও ফোর–হুইলার) প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিন থেকে প্রথম ১০ বছর করমুক্ত আয়ের সুবিধা পায়। পরের ১০ বছর তাদের মাত্র ১০ শতাংশ কর দিলেই হয়। এ ছাড়া দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে প্রথম ১০ বছর আয়করমুক্ত সুবিধা দেওয়া আছে।
এনবিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপিতে অবদান রাখা ৫০ শতাংশ পণ্যে ভ্যাট নেই। কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। এই খাতগুলো জিডিপিতে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে।
এ ছাড়া জিডিপিতে প্রায় ২৩ শতাংশ অবদান রাখা শিল্পপণ্যের ওপর ভ্যাট নেই। যেমন রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটর ভেহিকেল, মোবাইল ফোন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির সুবিধা আছে। এ ছাড়া ওষুধের কাঁচামাল, সাবান–শ্যাম্পুর কাঁচামাল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড উৎপাদনে কোনো ভ্যাট নেই। সফটওয়্যার উন্নয়নেও একই সুবিধা আছে।
এর বাইরে বিভিন্ন খাতের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় ভ্যাট দিতে হয় না। ৪৮৯টি প্রাথমিক পণ্য এবং জীবনধারণ ও রক্ষায় ব্যবহার করা বিভিন্ন মৌলিক পণ্যে প্রজ্ঞাপন দিয়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৫০ ধরনের সেবায় ভ্যাট নেই।
দেশে যত টাকার পণ্য আমদানি হয়, এর মধ্যে ৪৪ শতাংশের উপর শুল্ক–কর আরোপ করা হয় না। এসব পণ্য ও সেবার মধ্যে খাদ্যপণ্য, শিল্পায়নে ভূমিকা রাখে এমন পণ্যই বেশি। এ ছাড়া কিছু সরকারি প্রকল্পের পণ্য আমদানিতে শুল্ক–কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার কূটনীতিক এবং বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত আন্তর্জতাতিক সংস্থার গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা আছে বলে এনবিআর হিসাব করে দেখেছে।
এ ছাড়া শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ড–সুবিধা পায়। এসব প্রতিষ্ঠান বিনা শুল্কে কাঁচামাল এনে পণ্য বানিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে। এই সুবিধা পাওয়া শিল্পের মধ্যে পোশাকশিল্প অন্যতম।
এনবিআর হিসাব করে দেখেছে, ২০১৯–২০ অর্থবছরে দেশে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে শুল্ক–কর অব্যাহতি দেওয়ার কারণে ৪৪ শতাংশ বা ৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৬ কোটি টাকার পণ্যে কর আরোপ করা যায়নি।