খাতভেদে এবার নগদ সহায়তা কমবে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ। নতুন এই সিদ্ধান্ত আজ সোমবার শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে কার্যকর হবে।
পণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসতে পাঁচ মাসের ব্যবধানে আবারও ৪৩ খাতে নগদ সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। খাতভেদে এবার নগদ সহায়তা কমবে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশীয় পয়েন্ট। নতুন এই সিদ্ধান্ত আজ সোমবার শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ নতুন অর্থবছরে প্রযোজ্য হবে। প্রথম ধাপে গত ফেব্রুয়ারিতে খাতভেদে নগদ সহায়তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছিল।
একাধিক খাতের রপ্তানিকারকেরা বলছেন, একদিকে ব্যবসার খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে প্রণোদনা কমছে। এতে পণ্য রপ্তানিতে দেশীয় কারখানাগুলোর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে। তাতে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার শঙ্কাও আছে।
নগদ সহায়তার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাত। এত দিন দেশি সুতা ব্যবহার করে উৎপাদিত তৈরি পোশাক নতুন বাজারে রপ্তানি করলে একটি কারখানা সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ১ শতাংশ নগদ সহায়তা পেত। এখন সেটি কমে ৫ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়াবে। একইভাবে চামড়াজাত, পাটজাত, প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, আসবাব, প্লাস্টিক পণ্য, চা, ওষুধ ইত্যাদি পণ্য রপ্তানিতেও নগদ সহায়তা কমবে।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে রপ্তানি খাতে সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য নগদ সহায়তা কমায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বলা হয়, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশ হবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিধিবিধান অনুসারে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর কোনো ধরনের রপ্তানি প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা দেওয়া যায় না। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর একবারে সহায়তা প্রত্যাহার করা হলে রপ্তানি খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই এখন থেকে একটু একটু করে সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
অবশ্য ওই সময় তৈরি পোশাক ও বস্ত্রসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতাদের দাবির মুখে নগদ সহায়তা ১ জানুয়ারির পরিবর্তে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ ছাড়া পাঁচটি এইচএস কোডের তৈরি পোশাক সহায়তা পাবে না—এমন অবস্থানও প্রত্যাহার করা হয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এই রপ্তানি ছিল তার আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ শতাংশ।
পোশাক খাতে প্রভাব কেমন
দেশের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানির ৮৫ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের দখলে। ফলে এই খাতের উদ্যোক্তারা নগদ সহায়তার বড় অংশ পান। সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে পোশাক কারখানার নগদ সহায়তা কমবে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, প্রণোদনা কমানো হলে বেশি দাম দিয়ে দেশীয় বস্ত্রকল থেকে সুতা কেনার পরিবর্তে আমদানি করবে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা। এর ফলে অনেক দেশি বস্ত্রকল বন্ধ হবে। পোশাকশিল্প আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে। সেটি হলে রিজার্ভ কমবে, পোশাক খাতের মূল্য সংযোজনও কমে যাবে।
রপ্তানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র-ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে অর্ধেক বা দেড় শতাংশ করা হয়েছে। ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রপ্তানিকারকদের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। পোশাক খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার রপ্তানি প্রণোদনা ১ শতাংশীয় পয়েন্ট কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। নতুন পণ্য বা নতুন বাজারে প্রণোদনা ৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ২ শতাংশ। এ ছাড়া রপ্তানিতে বিশেষ নগদ সহায়তা দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে দশমিক ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানিতে প্রণোদনা কমিয়ে অর্ধেক করা হয়েছে। এমনটি হলে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না অনেক বস্ত্রকল। কারণ, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। প্রণোদনার অর্থ এত দিন কারখানাগুলোকে প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রেখেছিল।
অন্য খাতে প্রণোদনা কত কমল
চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বর্তমানে দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি কমেছে ১৪ শতাংশ। রপ্তানিতে ধুঁকতে থাকা চামড়া খাতের প্রণোদনাও কমছে। যদিও ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানো হয়েছে।
এ দফায় চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে প্রণোদনা ১২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রাস্ট লেদার রপ্তানিতে ৬ শতাংশ প্রণোদনা মিলবে। আর ফিনিশড লেদারে প্রণোদনা ৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে।
প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি কয়েক বছর ধরে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। সদ্য বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত ১১ মাসে এই খাত থেকে ৮৫ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় এসেছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ। নতুন নিয়মে কৃষিপণ্য ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্যে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এমন দুঃসময়ে বৈচিত্র্যময় পাটপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০, পাটজাত পণ্যে ৭ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং পাট সুতায় প্রণোদনা ৫ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
একইভাবে হালকা প্রকৌশল পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১২ থেকে ১০ শতাংশ, ওষুধের কাঁচামালে ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫, বাইসাইকেল রপ্তানিতে সাড়ে ৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ এবং আসবাব পণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ১০ থেকে ৮ শতাংশ করা হয়েছে।
এ ছাড়া হিমায়িত চিংড়ি, মোটরসাইকেল, ইলেকট্রনিকস, পেট বোতল ফ্লেক্স, জাহাজ, প্লাস্টিক পণ্য, হাতে তৈরি পণ্য যেমন হোগলা, খড়, আখ বা নারিকেলের ছোবড়া, তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট, গরু, মহিষের নাড়ি, ভুঁড়ি, শিং ও রগ, কাঁকড়া, কুঁচে, আগর, আতর ইত্যাদি পণ্য রপ্তানিতেও নগদ সহায়তা কমানো হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ২০২৬ সালের পরও প্রণোদনা অব্যাহত রাখার সুযোগ রয়েছে। সেই হিসেবে একটু তাড়াতাড়ি সহায়তা কমানো হচ্ছে। এতে রপ্তানিকারকদের সক্ষমতায় চাপ পড়বে। যদিও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে রপ্তানিকারকেরা কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় আছেন।