রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরের ডাল মিলে কাজ করছেন শ্রমিকেরা।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বরের ডাল মিলে কাজ করছেন শ্রমিকেরা।

জনপদের বাণিজ্য

বানেশ্বরের ডাল ব্যবসায় ধস

গত পাঁচ বছরে এ এলাকার শতাধিক ডাল মিল বন্ধ হয়ে গেছে। যাঁরা টিকে আছেন, তাঁদের ৮০ শতাংশই ব্যাংকঋণে জর্জরিত।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বানেশ্বর একটি ইউনিয়ন সদর। গত ৪০ বছরে এ ইউনিয়ন সদরে গড়ে উঠেছে প্রায় আড়াই শ ডালের মিল। ব্যবসায়ীদের হিসাবে, একসময় এই একটি এলাকা থেকে সারা দেশের বিভিন্ন ধরনের ডালের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেওয়া হতো। এ কারণে বানেশ্বর সদর হয়ে উঠেছিল ডালের অলিখিত রাজধানী। সেই ডালের রাজধানীর ব্যবসায় ধস নামে ২০১৭ সাল থেকে। তাতে গত পাঁচ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক মিল।

এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একসময় এ এলাকার আড়াই শ মিলে প্রায় ছয় হাজার মানুষের কর্মসংস্থানও হয়েছিল। পাশাপাশি এ ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রায় আধা কিলোমিটার এলাকায় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের ১১টি শাখাও স্থাপন করা হয়। ছোট্ট একটি এলাকায় প্রতিদিন লেনদেন হতো প্রায় চার কোটি টাকার। তাই এসব ডাল মিলকে কেন্দ্র করে শিল্পে অনগ্রসর উত্তরাঞ্চলের মানুষ দ্রুত শিল্পায়নের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। পাঁচ বছরে শতাধিক মিল বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি অনেক ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডালের বাজারের বড় অংশই এখন আমদানিনির্ভর। এ কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হারিয়ে গেছেন অনেক ব্যবসায়ী। সব মিলিয়ে এখন সচল রয়েছে প্রায় ১৫০টি মিল। তাদের ৮০ শতাংশই আবার ঋণের ভারে জর্জরিত।

গোড়ার কথা

আশির দশকের গোড়ার দিকে বানেশ্বর ইউনিয়নের হাট শিবপুর গ্রামে আবদুল হামিদ প্রথম ছোট আকারে একটি ডাল মিল চালু করেন। তাঁর দেখাদেখি বানেশ্বর বাজারে সতীশ নামের এক ব্যক্তিও আরেকটি মিল চালু করেন। মিল চালুর প্রথম কয়েক বছর ভালো ব্যবসা করেন তাঁরা। পরে আরও অনেকে এ ব্যবসায় যুক্ত হন। এরই একপর্যায়ে আবদুল হামিদের ছেলে ইনামুল বাবার ব্যবসার হাল ধরেন। কিন্তু প্রতিযোগিতায় টিকতে

না পেরে ১০ বছর আগে ইনামুল ব্যবসা গুটিয়ে নেন। আর সতীশ নামের ব্যক্তি তাঁর মিলটি বিক্রি করে দেন। শুধু তা–ই নয়, বানেশ্বর বাজারের সবচেয়ে ভালো জায়গাটি ছিল তাঁর। তিনি সেটিও বিক্রি করে দেন।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ১৯৯০ সালের দিকে এ ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। এর পরের ১০ বছরে এ ব্যবসার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল। আগেই থেকে বানেশ্বর দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। পাটসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের ব্যবসা হতো এ এলাকায়। ডাল মিল তথা ডালের ভালো ব্যবসা দেখে অন্য ব্যবসায়ীরাও ডাল মিল নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। অনেকে ডালের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ এলাকায় ডালের ব্যবসা মোটামুটি ভালোই চলেছে। ওই সময় বানেশ্বর থেকে সারা দেশের ডালের চাহিদার ৬০ শতাংশ সরবরাহ করা হতো। দিনে লেনদেন হতো প্রায় চার কোটি টাকার।

ব্যবসায়ীরা জানান, বানেশ্বরে ডালের ব্যবসার প্রসার ঘটেছিল মূলত কাঁচামালের সহজ জোগানের কারণে। স্থানীয়ভাবে তখন এই এলাকায় ভালো মসুর চাষ হতো। এই মসুর মিলে ব্যবহার করা হতো। পাশাপাশি একই জাতের মসুর চারঘাট এবং বাঘা সীমান্ত হয়ে ভারত থেকেও আসত। তখন ডালের উৎপাদন খরচ কম হতো। এখন বানেশ্বরে আগের মতো মসুর চাষ হয় না। ভারত থেকে সীমান্ত পথেও এ এলাকায় মসুর আসে না। ফলে এখন যেসব মিল চালু আছে, সেগুলো টিকে আছে মুগ ডালের ওপর ভর করে। এসব মিলের মুগ ডালের ৭০ শতাংশই আসে বরিশাল থেকে।

যেভাবে ধস নামল

১৯৯০ সালের দিকে সালাম-কালাম ডাল মিল বানেশ্বরে ভালো ব্যবসা করে। এই মিলের একজন অংশীদার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০১৪ সালের পর থেকে ব্যাপকভাবে বিদেশ থেকে মসুর ডাল আমদানি শুরু হয়। তখন দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ৭০ টাকা কেজি। আর আমদানি করা মসুর ডাল ৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি শুরু হয়। এতে মার খেতে শুরু করে দেশি মসুর ডাল। এতে বিপুল লোকসান গুনতে শুরু করে এ এলাকার মিলমালিকেরা। বিপুল পরিমাণ ডাল গুদামে পচে নষ্ট হয়ে যায়। এখানকার মিলমালিকদের সবাই ব্যাংকঋণ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছিলেন। ব্যবসা খারাপ হতে শুরু করলে ব্যাংকও ঋণ আদায়ে মিলমালিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করতে শুরু করে। ফলে একের পর এক মিল বন্ধ হয়ে যায়।

আবুল কালাম আজাদ আরও বলেন, এখন হাতে গোনা কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যবসা ধরে রেখেছেন। কিন্তু তাঁরাও ঋণে জর্জরিত। এ অবস্থায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এ এলাকার ব্যবসা ও মিলগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।

পারভেজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বাবর আলী এখনো চারটি মিল ধরে রেখেছেন। এসব মিলে প্রতিদিন প্রায় ২৫০ মণ ডাল ভাঙার সামর্থ্য রয়েছে। বাবর আলী বলেন, আমদানি করা মসুর ডাল বাজারে আসার পরই আমাদের ব্যবসার সর্বনাশ হয়েছে। এখনো আমাদের মিলে আড়াই থেকে তিন কোটি টাকার মসুর ডাল পড়ে আছে। এগুলোর প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ পড়েছে ১২০ টাকা। অথচ বাজারে এখন আমদানি করা বড় দানার মসুর ডাল ১০৫ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ব্যাংক ব্যবসায়ও ধস

ডাল ব্যবসায়ের উত্থানের সময় বানেশ্বরের মতো একটি ইউনিয়ন সদরে সরকারি ও বেসরকারি ১১টি ব্যাংকের শাখা খোলা হয়। বেসরকারি ন্যাশনাল ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স বা এনসিসি ব্যাংকের বানেশ্বর শাখার ব্যবস্থাপক ঈমান হোসেন বলেন, ‘একসময় গ্রামের শাখা খোলার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বানেশ্বরকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। ডালের ব্যবসার উত্থানের কারণে সবাই এখানে সম্ভাবনা দেখেছিল। পরে ডালের ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় তার প্রভাব ব্যাংকের ওপরও পড়েছে। ডাল ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যাংকগুলোর প্রায় ১০০ কোটি টাকা আটকে গেছে। আমাদের ব্যাংকেরও ৯ কোটি টাকার ঋণ আটকে গেছে। এরই মধ্যে এসব ঋণ খেলাপি হয়ে গেছে।’

বানেশ্বরে একদিন

রাজশাহী-নাটোর ও বানেশ্বর-চারঘাট সড়কের এক কিলোমিটার এলাকায় ডানে-বাঁয়ে যেদিকেই চোখ যায়, শুধু ডাল মিল। ভবনে ভবনে মিলের নাম আছে ঠিকই কিন্তু ভেতরে চলছে অন্য কারবার বা ব্যবসা। বানেশ্বর-চারঘাট সড়কের পাশে রয়েছে সালাম-কালামের দুটি ডাল মিল। সম্প্রতি দুটি মিলের একটিতে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে দুটি ট্রাক নষ্ট পড়ে আছে। এক পাশে পাট মজুত করা হয়েছে। আরেক পাশে অন্য একজন ব্যবসায়ীর মুগ ডাল ভাঙানোর কাজ চলছে। মিলের একজন কর্মচারী জানান, তাঁদের নিজের আর ব্যবসা নেই। মাঝেমধ্যে অন্য ব্যবসায়ীদের ডাল ভাঙিয়ে দেওয়া হয়। আরেকটি মিলে গিয়ে দেখা গেল, সেটি পুরোপুরি বন্ধ। মিলের সামনে তিনটি ট্রাক নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, একসময় সালাম-কালাম ছিলেন এ এলাকার অন্যতম উদ্যোক্তা। এখন তাঁদের ব্যবসা নেই।

সড়কের পশ্চিম পাশে একটি মিলের দেয়ালে বড় করে লেখা ‘মাসুদা ডাল মিল’। তার নিচে নতুন একটি ব্যানার ঝুলছে। সেখানে লেখা, মেসার্স রুমানা এন্টারপ্রাইজ। এটি মূলত আম, কাঁঠাল, লিচু, পাট ও ভুসিমালের আড়ত। এই আড়তের স্বত্বাধিকারী মো. হাসেম আলী বলেন, পরপর তিনজন ব্যবসায়ী ডাল মিলটি ভাড়া নিয়ে চালাতে পারেননি। সাত–আট মাস আগে তিনি আড়ত হিসেবে মিলটি ভাড়া নিয়েছেন।

বানেশ্বরের মাড়িয়া সড়কের পাশে এরশাদ এন্টারপ্রাইজের মিল। সাদেক আলী নামের একজন ব্যবসায়ী এখন মিলটি ভাড়া নিয়েছেন। সাদেক আলীর ছেলে সাইদুর রহমান বলেন, ব্যবসা ভালো চলছে না। একবেলা করে কোনো রকমে মিল চালানো হয়। বরিশাল থেকে এক ট্রাক মুগ এনে সপ্তাহজুড়ে ভাঙানো হয়। মাড়িয়া সড়কের রফিক ডাল মিলটি এখন অন্য একটি কোম্পানিকে গোডাউন হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আর সামনের চাতালটি ব্যবহার হচ্ছে গাড়ি গ্যারেজ হিসেবে।

ডাল ব্যবসার ট্র্যাজেডি

ডালের ব্যবসার উত্থান দেখে বানেশ্বরে সবাই ডাল মিল খুলতে শুরু করেছিলেন। যাঁদের পুঁজি ছিল না, তাঁরা ব্যাংক, এনজিও এবং মহাজন থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ব্যবসায় মার খেয়ে গত পাঁচ বছরে শতাধিক মিলমালিক ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে ঋণের দায়ে আত্মগোপনে।

ব্যবসার লোকসানের ভার ও ঋণের বোঝা বইতে না পেরে ২০১৬ সালে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন জেলার চারঘাট উপজেলার তাতারপুর গ্রামের ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন। সম্প্রতি কথা হয় তাঁর ছেলে সজীব হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাবার মৃত্যুর পর জায়গাজমি বিক্রি করে ৩০ লাখ টাকার ঋণ শোধ করেছি। বাবা মূলত প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবসা করতেন। ডালের ব্যবসার প্রসার দেখে বাবাও এ ব্যবসায় জড়ান। তাতে বড় ধরনের লোকসানে পড়েন।

তাতারপুর গ্রামেরই এক ডাল ব্যবসায়ী তিন বছর ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ বিষয়ে তাঁর পরিবারের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

এখনো টিকে আছেন যাঁরা

মন্দার মধ্যেও এখনো যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান টিকে আছে, তাদের একটি হাওয়া গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ওবায়দুর রহমান ডাল ব্যবসায়ী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। সম্প্রতি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বানেশ্বর এখন একটি রুগ্‌ণ শিল্প এলাকা। তবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখনো ব্যবসায় টিকে আছেন। বানেশ্বরে ওবায়দুর রহমানের নিজেরই ছয়টি মিল রয়েছে। এসব মিলে মুগ, কালাই, মসুর, ছোলা, খেসারি ও অ্যাংকার ডাল ভাঙানো হয়। পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও প্যাকেটজাত মসুর ডাল স্থানীয় বাজারে খুচরা বিক্রি করেন। ওবায়দুর রহমান জানান, একসময় বানেশ্বরের ডাল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছিল। এখন দেড়–দুই হাজার লোক কাজ করেন।