গত ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় এসেছে গত সেপ্টেম্বর মাসে—পরিমাণ ছিল ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ডলার।
ডলার–সংকটের সময় প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা এসেছে। গত সাড়ে তিন বছর বা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবাসী আয় এসেছে বিদায় নেওয়া সেপ্টেম্বর মাসে। গত মাসে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছে ১৩৪ কোটি ৩৬ লাখ ৬০ হাজার ডলার। এর আগে ২০২০ সালের এপ্রিলে এসেছিল ১০৯ কোটি ২৯ লাখ ৬০ হাজার ডলার।
দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি মিটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে প্রবাসী আয়। রপ্তানি আয় বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় উৎস হলেও বাংলাদেশে আমদানি ব্যয় বেশি। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় ঘাটতি থেকে যায়। বাকি দুই প্রধান উৎসের মধ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগের অবদান সামান্য, বৈদেশিক ঋণও আসছে কম। এ রকম এক পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ওপরও চাপ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ার কারণেই প্রবাসী আয় কমে যাচ্ছে। ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের হার বেশি কারণে হুন্ডির প্রসার বেড়েছে, এতে অর্থ পাচার করাও সহজ হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে অর্থ পাচারের ঘটনা বাড়ছে বলেও মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি গত মাসে বাংলাদেশ বেশি দামে প্রবাসী আয় কেনার বিষয়ে অনুসন্ধান ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কারণেও ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয় কেনার আগ্রাসী মনোভাব থেকে সরে এসেছে। এর প্রভাবও পড়েছে প্রবাসী আয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি (২ হাজার ১১৫ কোটি ৪৭ লাখ ৯০ হাজার ডলার)। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ ২ হাজার ৭০৫ কোটি ৭৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার। ২০২১ সালে এই রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারে উঠেছিল।
জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২০ দিনেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায় ১৬২ কোটি মার্কিন ডলার। আর এর পরের সাত দিনে কমেছিল আরও ৩০ কোটি ডলার। একই সময় পাল্লা দিয়ে কমেছে প্রবাসী আয়। আবার সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি আয়ও কমেছে আগের মাসের তুলনায় ৯ শতাংশের বেশি। এসব কারণেই রিজার্ভ কেবল কমছেই।
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজারে ডলারের পার্থক্য অনেক বেশি। এ কারণে বৈধ পথের চেয়ে অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে গেছে। এ ছাড়া নির্বাচন সামনে রেখে অর্থ পাচারের ঘটনাও বেড়েছে। এর ফলে বিদেশ থেকে প্রবাসীরা যে ডলার পাঠাচ্ছেন, তা আর দেশে আসছে না। কারণ, সেখানে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। যারা পাচারকারী, তারা দেশে টাকায় অর্থ পরিশোধ করছে আর বিদেশ থেকে ডলার সংগ্রহ করছে। এ চাহিদা কমানো না গেলে দেশে ডলার আসা বাড়বে না।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস মাত্রই শেষ হয়েছে। প্রথম প্রান্তিকের এই তিন মাসেই প্রবাসী আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যেমন গত জুলাই মাসে আয় ছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার, আর আগস্ট মাসে আয় আসে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার। সব মিলিয়ে এই তিন মাসে প্রবাসী আয় কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। প্রবাসী আয়ের এই ধারাবাহিক পতন অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কেননা, অল্প হলেও গত অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরের প্রবণতা প্রথম মাস থেকেই খারাপ।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে বরাবরের মতো সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এনেছে ইসলামী ব্যাংক—৩৪ কোটি ১৩ লাখ ডলার। এরপরই রয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক—১০ কোটি ৯৭ লাখ ডলার এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক—১০ কোটি ৪১ লাখ ডলার। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক সবাই মিলে এনেছে ১১ কোটি ৮৬ লাখ ডলার আর বেসরকারি ব্যাংকের অবদান ১১৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার।
প্রবাসী আয়ে এখন আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নগদ ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। শুরুতে এই প্রণোদনা ভালো ফল দিলেও পরে এর কার্যকারিতা হারায়। ফলে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা আড়াই শতাংশ করা হয়। কিন্তু তাতেও প্রবাসী আয় খুব বাড়েনি। এ অবস্থায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, সরকার ২ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার পর দেশে প্রবাসী আয়ের যে প্রবাহ তৈরি হয়েছিল, তা ধরে রাখা যায়নি। প্রতিবছর অনেক মানুষ কাজের জন্য বিদেশে যাচ্ছেন। বর্তমানে এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছেন, কিন্তু প্রবাসী আয় সেভাবে বাড়ছে না।
সব মহল থেকেই এখন বলা হচ্ছে হুন্ডির কারণেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেশে প্রবাসী আয় বাড়ছে না। আনুষ্ঠানিক বাজার ও অনানুষ্ঠানিক বাজারের ডলারের হারের পার্থক্যের কারণেই প্রবাসীরা হুন্ডিতে উৎসাহী হচ্ছেন। গত ১৫ জুন বিশ্বব্যাংকের ব্লগে প্রকাশিত একটি লেখায় সংস্থাটির সাউথ এশিয়া বিভাগের সিনিয়র ইকোনমিস্ট জো লিউ শি এবং পরামর্শক শিয়াও জু বলেছেন, অতি সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ঠিক রাখতে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহারের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এই বিধিনিষেধ বরং উল্টো ফল দিয়েছে এবং তাতে সংকট আরও বেড়েছে। এতে হুন্ডির চাহিদা বেড়েছে, ফলে রিজার্ভ আরও কমেছে।
তাঁরা বাংলাদেশের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, এখানে যখন আমদানির ঋণপত্র খুলতে ১০০ শতাংশ মার্জিনের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়, তখন ছোট আমদানিকারকেরা হুন্ডির প্রতিই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এর ফলে হুন্ডি বা সমান্তরাল বাজারে ডলারের দর আরও বৃদ্ধি পায়। যেমন ২০০২ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশে সরকারি এবং সমান্তরাল বাজারে ডলারের বিনিময় হারে পার্থক্য ছিল ২ শতাংশ।
কিন্তু আমদানিতে এলসি মার্জিন ১০০ শতাংশ আরোপ করার পরে এক মাসের মধ্যে বিনিময় হারের পার্থক্য বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১২ শতাংশ। এভাবে সমান্তরাল বাজারে বিনিময় হার বেড়ে গেলেই রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়সহ সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ অনানুষ্ঠানিক বাজারে চলে যায়। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকারি ও সমান্তরাল বাজারের মধ্যে বিনিময় হার ১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবাসী আয় ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে সরে হুন্ডির বাজারে চলে যায়।
প্রবাসী আয়ের এ ধরনের পতন দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, এভাবে প্রবাসী আয় কমলেও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং আমদানি বাণিজ্যে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। আর আমদানি কমে গেলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে আঘাত আসবে। এভাবে এক খাত থেকে আরেক খাত হয়ে অর্থনীতির সর্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।
ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, মূলত দুই কারণে বৈধ পথে প্রবাসী আয় কমছে। প্রথমত, ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডিতে ডলারের দাম বেশি। এ কারণে বৈধ পথের চেয়ে হুন্ডিতে ডলার পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন প্রবাসীরা। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে সামর্থ্যবানদের অনেকে দেশ ছাড়ছেন। তাতে অর্থ পাচারও বেড়ে গেছে। অর্থ পাচার যখন বাড়ে, তখন ডলারের চাহিদাই বেড়ে যায় সবচেয়ে বেশি। প্রবাসী আয় বাড়াতে বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সব মিলিয়ে দেশে ডলার আয়ের উৎসে এখন বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে।