একসময় মানুষের ভাত-কাপড়ের দাবি থাকলেও এখন আর মানুষ ভাত-কাপড়ের দাবি করে না বলে মনে করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার। তিনি বলেন, ‘এখন মানুষ সুন্দর জীবনযাপনের দাবি করে এবং এগুলো আমাদের অর্জন। এগুলোর জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। তবে আমরা এর শেষ বিন্দুতে পৌঁছে গেছি, তা বলছি না। আমাদের সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় করের হার, অর্থাৎ কর-জিডিপি হার বাড়ানোর জন্য।’
আজ মঙ্গলবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) আয়োজনে অনুষ্ঠিত ‘বাজেট ২০২৪-২৫: মূল চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ’ শীর্ষক প্রাক্-বাজেট আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শহীদুজ্জামান সরকার এসব কথা বলেন।
সংস্থাটির চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাকের সঞ্চালনায় এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন সংসদ সদস্য মো. নাসির শাহরিয়ার জাহেদী। আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, ঢাকা চেম্বার সভাপতি আশরাফ আহমেদ, প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি মো. রেফায়েত উল্লাহ মৃধা। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম আবু ইউসুফ।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে মুক্ত অর্থনীতির অনুসারী আমরা না। আমরা কল্যাণকর অর্থনীতির অনুসারী। জনকল্যাণকর অর্থনীতিতে দেশ চলছে। আর মূল্যস্ফীতি কমানোর একটা প্রক্রিয়া হলো সুদহার বৃদ্ধি। সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে।’ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার আট লাখ কোটি টাকা হবে বলেও জানান তিনি।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মো. শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, ‘আসন্ন বাজেটে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিফলন ঘটবে। আমি বিশ্বাস করি, এবারের বাজেট হবে জনগণের বাজেট। আর বাজেট শুধু কোনো সংখ্যা নয়, আয়–ব্যয়ের হিসাবও নয়। বাজেট করা হয় সরকারের রাজনৈতিক অভিলাষ, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পাঁচ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। আমদানি সংকোচন করায় রাজস্ব খাতে কিছুটা ভয়ের কারণ হয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় সীমাবদ্ধতা হয়তো আছে। এর সঙ্গে আমাদের অর্জনগুলোও বিবেচনা করতে হবে। আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, মানুষের চাহিদার ধরন বেড়েছে।’
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী মানুষ এখন ভাত-কাপড়ের দাবি করে না বললেও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। ২০২৩ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে আসে, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারে না—এমন মানুষ যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশের ওপরে আছে ভারত, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও চীন। প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারেন না, অর্থাৎ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য তাঁদের নেই। অথচ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দ্বিতীয় লক্ষ্য ক্ষুধামুক্তিতে (জিরো হাঙ্গার) ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও পুষ্টিমান অর্জনের কথা বলা হয়েছে।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, দেশে এখনো পরোক্ষ কর বেশি। অথচ উন্নত বিশ্বে বেশি হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর। এত দিন এসব জায়গায় সংস্কার আনা যায়নি। ২০০৯-১০ অর্থবছরের তুলনায় বাজেটের আকার আট গুণ বাড়লেও সে অনুযায়ী রাজস্ব আয় বাড়েনি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। বছরের শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করার পরিবর্তে বরং বছরজুড়ে এডিপি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হওয়া উচিত। আগামী দুই বছর পর উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের ধারাবাহিকতার বিবেচনায় বাজেটে নগদ সহায়তা ও ভর্তুকির বিষয়ে এখনই নজর দেওয়া দরকার বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
আলোচনা
সংসদ সদস্য মো. নাসের শাহরিয়ার জাহেদী বলেন, রাজস্ব আহরণ একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে গেছে, প্রান্তিক পর্যায়ে পর্যন্ত যেতে পারছে না। আর জনগণকে জানাতে হবে কর কোথায় কাজে লাগছে। যদি মানুষ সুবিধা বুঝতে পারে এবং এর প্রতি আস্থা তৈরি হয়, তাহলে মানুষ কর দিতে আগ্রহী হবে। কর খেলাপিদের বা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাড়তি সুযোগ দিলে সাধারণ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, বাজেট পাস হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হচ্ছে কম। আবার বাজেট করা হচ্ছে বড় আকারের। অথচ প্রতিবেশী ভারতে কয়েক পৃষ্ঠার বাজেট উপস্থাপন করা হয়।
এনবিআরের কর আদায়প্রক্রিয়া অনলাইন বা ডিজিটালাইজেশন না হওয়ার কারণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, ‘অনেক আগেই তা হওয়া উচিত ছিল। উপজেলা পর্যায়েও মানুষের আয় বেড়েছে, কিন্তু সে হারে করদাতা বাড়েনি।’ কর খেলাপিদের বাড়তি সুযোগ দেওয়ার কারণে সাধারণ করদাতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন বলেও মনে করেন তিনি।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, ব্যবসার ওপর করের চাপ বাড়লে অর্থনীতিতেও চাপ তৈরি হয়, যা নিতে পারে না অর্থনীতি। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী বাজেটে সংস্কারের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর ভবিষ্যতের বাংলাদেশের জন্য বিদেশি ঋণের প্রবাহ বাড়াতে হবে এবং কর না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়াতে হবে।
র্যাপিড চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে রাজস্ব খাতের সংস্কার দরকার। দরকার মুদ্রা বিনিময় হারের ব্যাপারেও সংস্কার আনা। আর আগামী বাজেটে সম্প্রসারণমূলক নীতি থাকলে মূল্যস্ফীতি কমানো চ্যালেঞ্জ হবে। তাই দরকার বাজেটে বড় ধরনের সংস্কার আনা। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল। তবে নির্বাচনের পর এখন সংস্কার করার উপযুক্ত সময়।