হারিয়ে যাওয়া বেলী কেডসের উদ্যোক্তাদের একজন আব্দুস সাত্তার। বর্তমানে তাঁরা স্টেপ জুতার পাশাপাশি উৎপাদন করছেন ভ্রমণের ট্রলি ব্যাগ। সেই ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামি ব্র্যান্ডের দোকানে।
একসময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্যের তালিকায় ছিল শুধুই পোশাক। ধীরে ধীরে রপ্তানি তালিকায় যুক্ত হয় কৃষি, মৎস্য, চামড়া, হস্তশিল্পসহ নানা খাতের নানা পণ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর আদেশের বিপরীতে পণ্য উৎপাদন করেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।
এরপর সেই পণ্য রপ্তানি হয়। আর কত ‘বিদেশি ব্র্যান্ড’, এমন এক জেদ থেকে ২০১৮ সালে ট্রলি ব্যাগের ব্র্যান্ড ওরনেট তৈরি শুরু করেন আব্দুস সাত্তার। সেই ট্রলি ব্যাগ এখন বিক্রি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। দেশটির হাজারের বেশি আউটলেটে বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের ট্রলি ব্যাগ।
হারিয়ে যাওয়া বেলী কেডসের কথা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে পড়ে। এই কেডসের দুজন উদ্যোক্তাদের একজন আব্দুস সাত্তার। তিনি এখন স্টেপ ফুটওয়্যারের কর্ণধার। তাঁদের গ্রেট লাগেজ অ্যান্ড লেদার গুডস তৈরি করে ভ্রমণের ব্যাগ ও ট্রলি। বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর আদেশের বিপরীতে রপ্তানিও করে। পাশাপাশি স্থানীয় বাজারেও বিক্রি হচ্ছে এই ট্রলি ব্যাগ।
হারিয়ে যাওয়া বেলী কেডস সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, বেলী কেডসের উদ্যোক্তারা এখন স্টেপ জুতা উৎপাদন করছেন। পাশাপাশি ভ্রমণ ট্রলি ও বাসায় রাখার ব্যাগও তৈরি করছেন। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা নরসিংদীতে। বেলী কেডসের উদ্যোক্তা আব্দুস সাত্তার হলেও এখনকার ব্যবসার বড় অংশ সামলাচ্ছেন তাঁর ছেলে শামীম কবির।
নরসিংদীতে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির তিনটি কারখানা। এসব কারখানা ঘুরে দেখা যায়, দুটি কারখানায় তৈরি হচ্ছে ভ্রমণের অন্যতম অনুষঙ্গ ট্রলি ব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক। আরেক কারখানায় জুতা তৈরির সরঞ্জাম। তিনটি কারখানাতেই পুরোদমে চলছে উৎপাদন। এসব কারখানা পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব। দূষণের কোনো বিষয় নেই তাতে।
কারখানার কর্মীরা জানান, যেসব উপকরণ দিয়ে ট্রলি ও ব্যাকপ্যাক তৈরি হচ্ছে, তার বেশির ভাগই আমদানি করা। তবে এসব পণ্য রপ্তানিতে প্রায় ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়। স্টেপের কারখানার সুবাদে আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাড়িতেও এখন ব্যাগ তৈরি হয়। কারখানা থেকে কাজ শিখে অনেক শ্রমিক নিজেরাই এখন নিজেরা ব্যাগ তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করছেন। এতে স্কুলগামী গ্রামের শিশুদের ব্যাগের চাহিদা মিটছে।
উত্তরার বেলী কমপ্লেক্সের স্টেপের প্রধান কার্যালয়। সেখানে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্ণধার আব্দুস সাত্তার ও শামীম কবিরের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ১৯৫৬-৫৭ সাল থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের ব্যাগের ব্যবসা ছিল। পরে জুতার ব্যবসায় যুক্ত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে নতুন করে ব্যাগের পাইকারি ব্যবসা শুরু করেন তাঁরা।
কিন্তু বেশি করের কারণে ব্যাগের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ছিল। এ সময় দেশে ভ্রমণের আগ্রহ বাড়তে শুরু করে। তাই কাঁচামাল আমদানি করে ২০১৪ সালে স্থানীয় বাজারের জন্য ব্যাগ তৈরি শুরু করেন বাবা-ছেলে মিলে। এরপরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করে। এখন স্থানীয় বাজারের চেয়ে রপ্তানি বাজারই বড়।
প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৩ লাখ মার্কিন ডলারের সমমূল্যের পণ্য রপ্তানি করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ২৯ লাখ ডলার। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ লাখ ডলারের ট্রলি, ব্যাগ ও ব্যাকপ্যাক রপ্তানি করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ক্রেতা এখন পিয়ারে কার্ডিন, ওয়াইল্ড ক্রাফট, ক্লেইন টুলস, আমেরিকান গিয়ার ও প্যাকলাইট।
ইউরোপের পাশাপাশি আমেরিকা ও ভারতের বাজারই গ্রুপটির অন্যতম বড় বাজার এখন। ভারত ও আমেরিকা চীনা পণ্য আমদানিতে বাড়তি কর বসিয়েছে। আর সেই সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশি কোম্পানি।
শামীম কবির বলেন, ‘বাবা (আব্দুস সাত্তার) সব সময় চাইতেন নিজেদের ব্র্যান্ড হবে। সেই ব্র্যান্ডের পণ্য যাবে সারা বিশ্বে। এ জন্য আমরা সাহস করে ওরনেট নামে ট্রলি ব্যাগ উৎপাদন শুরু করলাম। এখন আমাদের ওরনেট মিলছে উন্নত দেশের দোকানগুলোতেও।’
আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘দেশে একটি কারখানা করে পণ্য রপ্তানির জন্য যে অনুমোদন প্রয়োজন হয়, তাতে এক বছর সময় লেগে যায়। আবার এখন যুক্ত হয়েছে চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে না পারার সমস্যা। এসব সমস্যার সমাধান করা গেলে দেশে নতুন কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানিও বাড়বে। পোশাকের পর রপ্তানি সম্ভাবনাময় পণ্য হতে পারে ট্রলি ব্যাগ। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা।’
নতুন প্রকল্পের খোঁজখবর নিতে নিতে বেলী কেডসের পতনের কারণটিই জানা হয়নি। আব্দুস সাত্তারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধানীর লালবাগে। ১৯৬৮ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ওই বছরই বাবার লাগেজ ব্যবসায় যুক্ত হন। আব্দুস সাত্তার ও তাঁর বড় ভাই আবুল কাশেম মিলে জুতার ব্যবসা শুরু করেন ১৯৮৪ সালে। বেলী কেডস নামের সেই জুতা ওই সময় দেশে ব্যাপক পরিচিতি পায়। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দাপট দেখিয়ে ২০০০ সালে হারিয়ে যায় এই জুতার ব্র্যান্ড। পরে দুই ভাইয়ের মধ্যে ব্যবসা ভাগাভাগি হয়ে যায়। তাতে আবুল কাশেমের ভাগে পড়ে বেলী কেডস। কিন্তু আবুল কাশেম বেলী কেডসের ব্যবসাটি শেষ পর্যন্ত আর চালিয়ে নিতে পারেননি। এতে চমক দেখিয়ে হারিয়ে যায় বেলী কেডস।
আব্দুস সাত্তারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার শুরু ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে। প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো ব্যবসায়ী তাঁরা। দীর্ঘদিনের পুরোনো ব্যবসায়ী হলেও ব্যবসার আকারও সেভাবে বাড়েনি।
এর কারণ হিসেবে আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘আমরা কখনো চাইনি ব্যবসার পরিধি এত বড় হোক, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এ জন্য কখনো ব্যাংকঋণ নিয়ে নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান করিনি।
যা করেছি সবই নিজেদের পুঁজিতে। জুতা ও ব্যাগের উপকরণের নানা প্রতিষ্ঠান করেছি। পশ্চাৎ–মুখী সংযোগ শিল্প (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) থাকলে উৎপাদনে খরচ কমে। মান নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে পণ্যের মান ভালো হয়। কাঁচামালের জন্য কারও ওপর নির্ভর করতে হয় না।’