চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণের চরপোয়ালী গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল হোসেন। রাজধানীর নিউ সুপার মার্কেটের আগুনে তাঁর দোকান ভস্মীভূত হয়েছে। তবে শুধু জুয়েলের একার দোকান পোড়েনি, আগুনে পুড়েছে ভাইদের আরও ৩টি দোকান। এ ছাড়া মামা ও মামাতো ভাইদের আরও ৫টি, বোনজামাইয়ের পরিবারের ৫টি এবং চাচাদের ২টি মিলে তাঁদের মোট ১৬টি দোকান আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে।
অগ্নিকাণ্ডের মতো একটি ভয়াবহ দুর্যোগ একটি পরিবারে কী কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, সবাইকে হঠাৎ করে নিঃস্ব করে দিতে পারে, নিউ সুপার মার্কেটের আগুন হয়তো তার একটি উদাহরণ। জুয়েল হোসেন এবং তাঁর সম্প্রসারিত পরিবার যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটে গেছে। আত্মীয়স্বজনের সবকিছু হারিয়ে এখন তাঁদের এমন অবস্থা যে কেউ কারও কাছে হাত পাতার মতো অবস্থায়ও নেই।
নিউ সুপার মার্কেটে সরেজমিনে ঘুরে জানা গেল, জুয়েল হোসেনের পরিবারের দোকানগুলো ছিল মার্কেটের তিনতলায়। জুয়েল ও তাঁর ভাইদের দোকানগুলো হলো ম্যাক্স পয়েন্ট, ডেনিম গ্যালারি, হাবিব ফ্যাশন ও হাবিব ফ্যাশন-দুই।
মামা ও মামাতো ভাইদের দোকানগুলোর নাম হালিমা ফ্যাশন, তাসমিয়া ব্লক অ্যান্ড বুটিকস, বৃষ্টি কালেকশন, খান প্যান্ট হাউস ও হোসনেয়ারা বুটিকস। বোনজামাইদের প্রতিষ্ঠানগুলো আলী ফ্যাশন এক ও দুই, মাহাব প্যান্ট, ড্রিম টাচ গ্যালারি ও মারিয়া প্যান্ট হাউস। দীপা ও মাহি ফ্যাশন নামে চাচাদের আরও দুটি প্রতিষ্ঠান ছিল।
এসব প্রতিষ্ঠানের সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ১৫ এপ্রিলের ভয়াবহ আগুনে।
জুয়েল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় নিউ সুপার মার্কেটের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে বংশপরম্পরায় ঢাকাতেই তাঁরা ব্যবসা করছেন। পরিবারের একজন একটু ভালো অবস্থায় আসার পর তিনি আবার অন্য আরেকজনকে এখানে ব্যবসায় এনেছেন। এভাবেই পরিবারের সবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বেড়েছে।
‘পাশাপাশি থাকার ফলে একে অন্যের সুবিধা হবে বলে আমরা মনে করেছি। কিন্তু এই পাশাপাশি থাকার ব্যাপারটাই আজ আমাদের সবাইকে পথের ফকির বানাল। বিপদে পড়লে সাধারণত যেসব আত্মীয়স্বজন এগিয়ে আসার কথা, আজ তাঁরা সবাই নিঃস্ব,’ গভীর আক্ষেপ শোনা গেল তাঁর কথায়।
ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যে কারও কাছে হাত পাতবেন এমন আর কেউ নেই বলে জানালেন জুয়েল হোসেন। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে তাঁদের দোকানগুলোতে গড়ে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। এর মধ্যে তাসমিয়া ব্লক ও বুটিকসে যে মালামাল ছিল, তার মূল্য ছিল ৫০ লাখ টাকার মতো। ফলে সব মিলিয়ে এই ১৬ দোকানে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি টাকার বেশি।
‘তিলে তিলে গড়া এসব প্রতিষ্ঠানই ছিল আমাদের পরিবারের রুটি-রুজির উৎস,’ বললেন এই ব্যবসায়ী। সেখানেই কথা হলো জুয়েলের বোন জামাই সোলাইমান হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁর ভাইদের যেসব প্রতিষ্ঠান ছিল সবগুলো ঋণের টাকার গড়ে উঠেছে। তিনিই কেবল কোনো ঋণ করেননি। ফলে তাঁর অন্তত এ মুহূর্তে দেনার চাপ নেই। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো পুড়ে যাওয়ায় বাকি সবার ওপর ঋণের বাড়তি বোঝা চাপল।
‘সব মিলিয়ে আমরা এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছি,’ প্রথম আলোকে বললেন সোলাইমান হোসেন। জুয়েলের বড় ভাই সিদ্দিকুর রহমান। তিনি ১৯ বছর আগে চাচাদের ব্যবসা দেখে প্রবাসী বড় ভাইয়ের নামে হাবিব ফ্যাশন নামের দোকান গড়ে তুলেছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের প্রতিটি দোকানে ৩ থেকে ৫ জন কর্মচারী ছিলেন। সেই হিসাবে ৫০ থেকে ৬০ জন, যাঁরা কাজ করতেন তাঁরাও বিপদের মধ্যে পড়ে গেলেন।
‘যেহেতু ব্যবসা নেই, তাই কর্মচারীরা এখন বেতন-বোনাস নিয়ে বাড়ি যেতে চায়। কিন্তু পাওনা মেটানোর মতো টাকা আমাদের কাছে নেই। এখন ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একটা পথ খুঁজছি,’ বলেন তিনি।
তবে নিউ সুপার মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডে যে শুধু যে মালামাল পুড়েছে তা–ই নয়, পুড়েছে দোকানে রাখা নগদ টাকাও। ঈদ মৌসুম হওয়ায় জুয়েল হোসেনদের দোকানগুলোতে ৩০ লাখের মতো নগদ টাকা ছিল। সেসব টাকাও পুড়েছে।
ড্রিম টাচ গ্যালারি নামের প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী রবিউল আওয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেচাকেনার মৌসুম হওয়ায় দোকানে নগদ টাকা রেখেই সাধারণত আমরা শেষ রাতে বাসায় ফিরি’। এ ছাড়া ব্যাংক হিসাবসহ সার্টিফিকেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পুড়ে যাওয়ায়ও চিন্তিত তিনি।
ঈদের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে গত শনিবার ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে ঢাকা নিউ মার্কেটসংলগ্ন ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে যোগ দেয় সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ সার্বিক নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। এই ঘটনার আড়াই শ দোকানপাট পুড়ে গেছে। আর সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ শতাধিক প্রতিষ্ঠান।