প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ দিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা।
ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলার একটি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা গত বছর চীন থেকে প্রায় ৯০ হাজার কেজি কাপড় আমদানির ঋণপত্র খোলে। তিন ধাপে এই কাপড় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসে। শেষ ধাপে ২২ হাজার কেজি কাপড় আসার কথা ছিল। তবে ১ হাজার ৭০০ কেজি কাপড় বেশি আসে। কাস্টমস কর্মকর্তারা মিথ্যা ঘোষণার অভিযোগে তৃতীয় ধাপে আসা পুরো কাপড় জব্দ করেন। পরে মিথ্যা ঘোষণার অভিযোগে ওই পোশাক কারখানাকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে বাড়তি আসা কাপড়ের শুল্ক বাবদ সাড়ে চার লাখ টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশও দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কারখানাটির একজন প্রতিনিধি বলেন, কাস্টমসের জরিমানা ও শুল্ক ছাড়াও বন্দরে নির্ধারিত সময়ের বেশি পণ্য রাখার মাশুল গিয়ে ১৫ লাখ টাকা দাঁড়ায়। তত দিনে দুই মাসের বেশি সময় চলে যায়। পণ্য জাহাজীকরণের সময়ও পার হয়। শেষ পর্যন্ত বিদেশি ক্রেতার কাছে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড়ে সেই পোশাক রপ্তানি করতে হয়। অথচ মূল ঋণপত্র (মাস্টার এলসি) এবং ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র ও কাঁচামাল আমদানি প্রাপ্যতায় (ইউডি) উল্লেখ ছিল ৩ শতাংশ পণ্য বা কাপড় কমবেশি গ্রহণযোগ্য। সে অনুযায়ী ২ হাজার ৬০০ কেজি কাপড় বেশি এলেও সমস্যা ছিল না।
পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানিতে কাস্টমসের এমন হয়রানি নিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই ক্ষুব্ধ। সেই অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকেও তুলে ধরলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা। গত শনিবার রাতে গণভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাণিজ্য সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। বৈঠকে তাঁরা কাস্টমসের হয়রানি বন্ধ ছাড়াও ব্যাংকঋণের সুদের হার ১১-১২ শতাংশের মধ্যে রাখা, আমদানিকারকদের নির্ধারিত দরে ডলার সরবরাহ, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ, নগদ প্রণোদনা অব্যাহত রাখার দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৈঠকে কাস্টমসের কর্মকর্তাদের হয়রানির বিষয়ে কয়েকজন ব্যবসায়ী কথা বলেন। তাঁরা বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তারা করের চেয়ে জরিমানা আদায়ে বেশি উৎসাহ দেখান। কারণ, জরিমানার একটি অংশ কর্মকর্তারা পান। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কর্মকর্তাদের ঘুষ দিলে জরিমানা দিতে হয় না। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা টাকা দেন কেন? জবাবে একজন ব্যবসায়ী বলেন, মূলত হয়রানি এড়াতেই ব্যবসায়ীরা টাকা দেন। কারণ, জরিমানার প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক সময় লাগে। অথচ সময়মতো পণ্য না পেলে কারখানার উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি যথাসময়ে পণ্য দিতে না পারলে রপ্তানি ক্রয়াদেশও বাতিল হয়ে যায়। তাই বাধ্য হয়ে জরিমানা এড়াতে টাকা দিয়ে আপসরফা করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বৈঠকে উপস্থিত একজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, দীর্ঘদিন একই এইচএস কোডে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে কাস্টমস কর্মকর্তারা ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করেছেন। তাঁদের দাবি, এইচএস কোড ভুল দিয়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ পয়সা দিলে আবার জরিমানা লাগছে না। তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী জরিমানা থেকে কর্মকর্তাদের কমিশনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা বলেছেন। তার বদলে নতুন কাউকে করজালে আনতে পারলে প্রণোদনা দেওয়ার চিন্তাভাবনার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
কাস্টমসের হয়রানির বিষয়ে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, আইনের মধ্যে থেকেই কাস্টমস কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করছেন। এইচএস কোডে দাঁড়ি-কমা ভুল হলে কিংবা ওজন কমবেশি হলে বিশাল অঙ্কের জরিমানা করে বসেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
কাস্টমসে বিজিএমইএর সদস্যদের এক লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা মুখে পড়তে হয়েছে বলে অভিযোগ করে এস এম মান্নান বলেন, ‘ব্যবসার খরচ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। আমরা টিকে থাকার লড়াই করছি। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সহযোগিতা দরকার। আমরা মনে করি, অধিকাংশ কর্মকর্তা ভালো। গুটিকয় কর্মকর্তা ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেন।’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বাংলাদেশ ব্যবসায় পরিবেশ ২০২৩-এর উদ্যোক্তা জরিপের ফলাফল প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে ১ নম্বর সমস্যা দুর্নীতি। প্রায় ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী উচ্চমাত্রার দুর্নীতিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর পণ্য আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়। কাঁচামাল আমদানিতে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ী দুর্নীতির শিকার হন।
জানতে চাইলে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়াটি অটোমেশন হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছেন কিছু কর্মকর্তা। বাংলাদেশে বর্তমানে বহুমুখী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানি-রপ্তানি হয়। সে জন্য এইচএস কোড আরও সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত। এ বিষয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ নেওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি।