তীব্র ইচ্ছাশক্তির জোরে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে নিঃস্ব হয়েও সপ্তাহ না পেরোতেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছেন বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা। দোকান পুড়ে যাঁরা নিঃস্ব হয়েছেন, তাঁদের অনেকে ইতিমধ্যে ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করেছেন। আগুনে পুরোটা পুড়ে যাওয়া থেকে যেসব দোকান বেঁচেছে, তাতে এবার রঙের আঁচড় লাগতে শুরু করেছে। কেউ কেউ নতুন সাজের দোকানে মালামালও তুলে ফেলেছেন। এ যেন পোড়া কালির রেখা রুখে নতুন স্বপ্নের উঁকি, তীব্র প্রতিজ্ঞায় জানান দিচ্ছে, আমরা একদল ফিনিক্স!
সরেজমিনে বঙ্গবাজার ঘুরে দেখা গেছে, গতকালের (শনিবার) মতো আজ রোববারও শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী উড়ালসড়কের নিচে এবং এনেক্সকো টাওয়ার–সংলগ্ন এলাকায় অস্থায়ীভাবে দোকান পেতে বসেছেন। তাতে ব্যবসায়ীরা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে যে বসতে পেরেছেন, তা হয়তো বলা যাবে না। অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডের পরে এই এলাকায় ক্রেতার চেয়ে উৎসুক জনতার সংখ্যাই এখনো বেশি। ফলে এখানকার ব্যবসায়ীদের বেচাকেনা কম বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বঙ্গ হোমিও মার্কেটের সামনের সারির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ইসমাঈল গার্মেন্টসের মালিক খলিল খান জানালেন, তাঁর দুটি দোকানের ২৫ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। তবে কংক্রিটের বিধায় দোকানের কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আর দেরি না করে তিনি নেমে পড়েছেন নতুন করে আবার শুরু করতে।
‘দোকানে রং লাগিয়ে নতুন করে শুরু করার জন্য মিস্ত্রি দিয়ে কাজ করাচ্ছি’, প্রথম আলোকে বলেন তিনি। ‘আজ-কালকের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেলে পাইকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করব। তাঁরা বাকিতে মালামাল দিলে নতুন করে শুরু করা সম্ভব হবে। না হয় ব্যবসা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।’
বঙ্গ হোমিও মার্কেটের নিচতলার পাশের তাফসির তানিম ফ্যাশনের মালিক শফিকুল ইসলাম অবশ্য ইতিমধ্যে রঙের কাজ শেষ করে নতুন করে মালামাল উঠিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুড়ে যাওয়ার আগে আমার দোকানে ১৬ থেকে ১৭ লাখ টাকার মালামাল ছিল। একটা মালও বের করাতে পারিনি। রং লাগিয়ে নতুন করে শুরু করেছি। তবে রাস্তা বন্ধ থাকায় ক্রেতারা আসতে পারছেন না। তাতে বেচাকেনা নাই বললেই চলে।’
শফিকুল ইসলামের দাবি, বঙ্গবাজারের পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ দ্রুত সরিয়ে ব্যবসার পরিবেশ স্বাভাবিক করা হোক।
পাশের বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটের জিংক প্লাসের ব্যবস্থাপক মো. বিপ্লবকে দেখা গেছে কাপড়ের তাকে নতুন করে জামাকাপড় ওঠাতে। তিনি প্রথম আলোকে জনান, আগুনে তাঁদের বেশ কিছু মালামাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তবে এখন তাঁরা আবার ব্যবসায় ফেরার চেষ্টা করছেন।
নতুন সাইনবোর্ড
তবে শুধু রং লাগানো নয়, অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নতুন করে সাইনবোর্ড বা নামফলক টানিয়ে অস্তিত্বের জানান দেওয়ারও চেষ্টা করছে। স্টাইল লাইফ নামের একটা প্রতিষ্ঠানে দেখা গেল নতুন সাইনবোর্ড। বঙ্গ হোমিও মার্কেটের দোতলায় থাকা প্রতিষ্ঠানটি আগুনে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সেখানে বিক্রেতা রিফাত হোসেন বলেন, ‘যত দ্রুত আমরা ব্যবসায় ফিরতে পারব, তত দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।’ নতুন করে শুরু করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বঙ্গবাজারের যেসব দোকান পুরোপুরি পুড়ে গেছে, সেগুলোর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা অবশ্য পুড়ে যাওয়া স্থানেই আবার দোকান শুরু করতে চান। সে জন্য প্রতিনিয়ত তাঁরা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন।
ব্যবসায়ী নেতারা অনুদান সংগ্রহকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। সিটি করপোরেশনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, রোববার পর্যন্ত প্রায় দুই কোটি টাকা সংগৃহীত হয়েছে। তবে রোববারের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের একটি তালিকা সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়ার কথা থাকলেও সেই তালিকার মাত্র ৭০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যবসায়ী ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসলেও তাঁদের বেচাকেনা কম।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের সামনের ফুটপাতে অস্থায়ীভাবে বসা প্রতিষ্ঠান শিহাব হোসিয়ারির বিক্রেতা আরমান হোসেন জানালেন, তিনি বেঁচে যাওয়া মালামাল নিয়ে সেখানে বসেছেন এবং সকাল থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত তিন হাজার টাকার মালামাল বিক্রি করেছেন, যা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম।
‘মৌসুমের এই সময়ে আমার দৈনিক বেচাকেনা অর্ধলাখ টাকা ছাড়িয়ে যেত। এখন অবশ্য ওই হিসাব করে লাভ নেই, বাস্তবতা মেনে ফুটপাতেই ব্যবসা করছি,’ কণ্ঠে তাঁর খানিকটা হতাশার সুর থাকলেও ছিল কিছুটা দৃঢ়তাও।
ফুটপাতে বসা আরেক দোকানদার নূর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজকে প্রথমবারের মতো ফুটপাতে দোকান নিয়ে বসেছি। কিন্তু সকাল থেকে বিকেল হয়ে এলেও মাত্র ৪০০ টাকার জামা-প্যান্ট বেচতে পেরেছি।’
পুঁজি ভাঙিয়ে তাঁকে এখন সংসার খরচ চালাতে হচ্ছে বলে জানালেন তিনি।