চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানের ঋণ–সাহায্য কমেছে, বেড়েছে বিশ্বব্যাংকের

গত অর্থবছরে এডিবি, চীন, রাশিয়া ও ভারত আগের চেয়ে কম অর্থ দিয়েছে। কমেছে এনজিওর বিদেশি সহায়তাও।

বাংলাদেশের জন্য সাহায্য ও ঋণ কমে গেছে। বড় ঋণদাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর মধ্যে কেবল বিশ্বব্যাংক ছাড়া বাকি প্রায় সবাই ঋণের ছাড় কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) এবং চীন, রাশিয়া ও ভারত থেকে বাংলাদেশ আগের তুলনায় কম ঋণ পেয়েছে।

বর্তমান ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় এসব বহুজাতিক সংস্থা ও দেশগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া নির্বাচনের বছরে এসব দেশের অর্থছাড় কম হওয়া নিয়েও বেশ আলোচনা হচ্ছে। শুধু বড় দেশ ও বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা নয়; বিদেশি সাহায্য সংস্থার ঋণের অর্থছাড়ের পরিমাণও কমেছে। এসব অর্থ এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর মাধ্যমে আসে।

কয়েক বছর ধরেই বড় বড় দাতা সংস্থা ও দেশগুলোর ঋণের অর্থছাড় বেড়েছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী অর্থবছরের আগের বছরের চেয়ে একলাফে ৭৪ কোটি ডলার অর্থছাড় কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড ১ হাজার ১ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা ছাড় হয়। গত অর্থবছরে উন্নয়ন সহযোগীরা সব মিলিয়ে ৯২৭ কোটি ডলার দিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের মাত্র ৮৮০ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের চেয়ে ১৩৭ কোটি ডলার কম।

বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রভাব আছে, এমন বড় দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চীন, রাশিয়া, ভারত। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপান—এসব সংস্থা ও দেশ নমনীয় শর্তের ঋণ দেয়। এসব সংস্থা ও দেশ পশ্চিমা দেশগুলোর আদলে সুশাসনের সঙ্গে অর্থ খরচকে প্রাধান্য দেয়। প্রচ্ছন্নভাবে এসব সংস্থা ও দেশে পশ্চিমা দেশের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটে। অন্যদিকে চীন, রাশিয়া, ভারত কঠিন শর্তের সরবরাহকারী ঋণ দেয়। এসব দেশের ঋণ নিলে তাদের ঠিকাদারকে কাজ দিতে হয়।

ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিডের কারণে বড় দেশগুলোর অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। তাদের প্রবৃদ্ধিও কমেছে।
শামসুল আলম, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

কেন ঋণ ছাড় কমল—এমন প্রশ্ন করা হলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিডের কারণে বড় দেশগুলোর অর্থনীতিতে চাপ পড়েছে। তাদের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। পর্যাপ্ত সম্পদ সৃষ্টি না হলে ওই সব দেশ বাড়তি অর্থ বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দিতে পারবে না। এ ছাড়া আফ্রিকার দেশগুলোতে চাহিদা বেড়েছে। দাতা সংস্থা ও দেশগুলো এখন তাদের বরাদ্দের অর্থ আরও বেশি দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।

নির্বাচনের বছর ঋণ কমার প্রসঙ্গে শামসুল আলম বলেন, নির্বাচন বিবেচনা করে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থা ঋণ দেয় না। তারা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঋণ দেয়। কোনো দেশে বড় কলহ না হলে কেউ ঋণ কমায় না। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি মোটা দাগে ভালো আছে।

কে কত ছাড় করল

গত অর্থবছরে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি। যদিও এডিবির ঋণের অর্থছাড় কমেছে। আগের বছরের চেয়ে ১০১ কোটি ডলার কম দিয়েছে এডিবি। সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে সংস্থাটি দিয়েছে ১৫৬ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল ২৫৭ কোটি ডলার।

তবে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। গত অর্থবছরে বিশ্বব্যাংক ১৯৩ কোটি ডলার ছাড় করেছে, যা আগেরবারের চেয়ে ২৬ কোটি ডলার বেশি। আরেক বহুজাতিক সংস্থা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) আগেরবারের চেয়ে গত অর্থবছরে ৫ কোটি ডলার কম দিয়েছে। গত অর্থবছরে সংস্থাটি ২৪ কোটি ডলার দিয়েছে। এসব সংস্থার পাইপলাইনে বাংলাদেশের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ পড়ে আছে। ইআরডির প্রাথমিক হিসাবে এই তথ্য পাওয়া গেছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ করেনি ইআরডি।

অন্যদিকে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে যেসব দেশের কাছ থেকে বাংলাদেশ ঋণ নেয়, তাদের মধ্যে সব বড় দেশই গত অর্থবছরে অর্থছাড় কমিয়ে দিয়েছে। প্রথমেই দেখা যাক, দীর্ঘদিনের বন্ধুপ্রতিম দেশ জাপান কত অর্থ দিয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরে জাপান আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৭ কোটি ডলার কম দিয়েছে। গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২০৪ কোটি ডলার দিয়েছে, যা যেকোনো ঋণদাতা দেশ ও সংস্থার মধ্যে সর্বোচ্চ।

চীন ও রাশিয়াও অর্থছাড়ে আগ্রহ কম দেখিয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন বিভিন্ন প্রকল্পে ১০১ কোটি ডলার দিয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরে এর পরিমাণ কমেছে। গত অর্থবছরে ৮৯ কোটি ডলার ছাড় করেছে। রাশিয়ারও একই অবস্থা। গত অর্থবছরে ৯৯ কোটি ডলার দিয়েছে। এর আগের বছরে পরিমাণ ছিল ১২২ কোটি ডলার। মূলত রূপপর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া।

চীন ও রাশিয়ার মতো ভারতের অর্থছাড়ের দশাও একই রকম। গত অর্থবছরে ভারত সব মিলিয়ে ২৯ কোটি ডলার ছাড় করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশটি ৩২ কোটি ডলার দিয়েছিল। তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) মাধ্যমে ৭৩৬ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। গত এক যুগে সব মিলিয়ে ১৪৯ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে।

গত অর্থবছরে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি। যদিও এডিবির ঋণের অর্থছাড় কমেছে। আগের বছরের চেয়ে ১০১ কোটি ডলার কম দিয়েছে এডিবি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের সময় টিকা কেনা, হাসপাতাল সরঞ্জামাদির জন্য জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা দিয়েছিল। তখন বেশি অর্থ এসেছিল। কিন্তু এখন ঋণের প্রবাহ স্বাভাবিক ধারায় ফিরে এসেছে। এ ছাড়া রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধও অর্থছাড় কমার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

ঋণের অর্থছাড় সম্পর্কে জানতে ইআরডি সচিব শরিফা খানের সঙ্গে মুঠোফোনে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া খুদে বার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

তবে ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বড় ঋণদাতা সংস্থা ও দেশগুলো চাপে আছে। ওই সব দেশ ও সংস্থা কিছুটা ধীরে চলো নীতি নিয়েছে। তাই তারা ঋণের অর্থছাড়ে গতি কমিয়েছে। তাঁরা আরও বলেন, প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার কোটি ডলার বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন পড়ে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাপানের কাছ থেকে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার পাওয়া যায়। বাকি চাহিদা মেটাতে চীন, ভারতের মতো দেশের কাছে সরবরাহ ঋণ নিতে হয়।

নির্বাচন বিবেচনা করে ঋণদাতা দেশ ও সংস্থা ঋণ দেয় না। তারা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ঋণ দেয়। কোনো দেশে বড় কলহ না হলে কেউ ঋণ কমায় না। বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি মোটা দাগে ভালো আছে।
শামসুল আলম, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

এনজিওর বিদেশি সহায়তাও কমেছে

সরকারের পাশাপাশি দেশে কর্মরত দেশি–বিদেশি বেসরকারি সাহায্য সংস্থাও (এনজিও) বিদেশ থেকে অর্থ আনে। এসব অর্থ আসে এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর মাধ্যমে। এই সরকারি সংস্থা এসব অর্থের হিসাব রাখে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) এনজিওর বিদেশি সহায়তাও কমেছে। গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৭৪ কোটি ডলার বিদেশি সহায়তা এসেছে; যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০২১-২২ অর্থবছরে অর্থসহায়তা এসেছিল ৮২ কোটি ডলার।

এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর পরিচালক তপন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি সহায়তা উল্লেখযোগ্য হারে কমেনি। প্রতিবছর সহায়তা কম–বেশি হয়। করোনার পাশাপাশি বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের কারণে গত অর্থবছরে সহায়তা কমেছে বলে তিনি মনে করেন।

ভালো খবর হলো, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সুফল পেয়েছে এনজিওগুলো। ডলারের হিসাবে সহায়তা কমলেও টাকার হিসাবে বেড়েছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত অর্থবছরে সোয়া চার শ কোটি টাকা বেশি পেয়েছে এনজিওগুলো।

এনজিএর বিদেশি সহায়তা কমার চারটি কারণ আছে বলে মনে করেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। যেমন প্রথমত, কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অনেক দেশ ও বহুজাতিক সাহায্য সংস্থা নিজেরাই অর্থসংকটে আছে। এ জন্য বাংলাদেশে বিশেষ করে রোহিঙ্গাসংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতে তহবিল ছাড় কমেছে। দ্বিতীয়ত, প্রক্রিয়াগত জটিলতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দেশে সুশাসন ও অধিকার নিয়ে কাজ করা এনজিওগুলোর তহবিল প্রবাহ কমেছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বের হচ্ছে। তাই এর প্রভাবেও এনজিওগুলো অর্থ কম পাচ্ছে। চতুর্থত, বিশ্ব প্রেক্ষাপটে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক শরণার্থী গেছে। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে ইউরোপের বড় দেশ ও সাহায্য সংস্থাগুলোকে সেখানেই বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এর ফলে অন্য দেশের জন্য তাদের বরাদ্দ কমছে।