স্বাচ্ছন্দ্যের বিদায়, বাজারে কাটছাঁট, পুষ্টিতে আপস

আবদুল গনী আনছারীর বাড়ির কাছে হাট মেলে সপ্তাহে দুই দিন। গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল হাটের দিন। তিনি হাটে গিয়েছিলেন। এক কেজি আলু, আধা লিটার সয়াবিন তেল ও আরও কিছু নিত্যপণ্য কিনেছেন। কোনো মাছ বা মাংস কেনেননি।

আবদুল গনী বিকেলে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, আগে এমন কোনো হাট যায়নি, যে হাটে তিনি মাছ কেনেননি। এবার খুব কষ্ট। মাছ কেনা ও দোকানে চা–নাশতা খাওয়া তিনি বাদ দিয়েছেন। কেন কষ্ট, সেই ব্যাখ্যাও তিনি দিলেন। বললেন, বছরে এক মৌসুমে যে ধান পান, তা দিয়ে সারা বছর সংসারের খরচ চালান। এবার ধান পেয়েছেন ৫০ মণের মতো, যা আগের বছরের অর্ধেক। ওদিকে নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপক চড়া।

আবদুল গনী জানালেন, শুধু তাঁর পরিবার নয়, তাঁর গ্রামের বহু পরিবার এবার বিপাকে পড়েছে। কারণ, কারও ধানে চিটা ছিল বেশি, ফলন কম হয়েছে। কারও ধান ভয়াবহ বন্যায় ডুবে নষ্ট হয়েছে।

ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ ধরনের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি মানুষ কাটানোর চেষ্টা করে। নিম্নবিত্তের আয়ের বড় অংশ যায় খাবারের পেছনে।
সেলিম রায়হান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

আবদুল গনী সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মুক্তিখলার বাসিন্দা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) গত সপ্তাহের এক জরিপে বলা হয়, দেশের দুটি বিভাগের মানুষ এখন বেশি কষ্টে আছে—বরিশাল ও সিলেট। বরিশালে দরিদ্র মানুষ বেশি, সিলেট এবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরিপে ৮৮ শতাংশ উত্তরদাতা গত ছয় মাসে তাদের ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হিসেবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে উল্লেখ করেন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কয়েকটি পরিবারের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তারা বাজারে চড়া দামের পরিস্থিতিতে কী অবস্থায় রয়েছে। পরিবারগুলো বলছে, তারা নানাভাবে ব্যয় কমিয়ে কঠিন সময় পার করার চেষ্টায় রয়েছে।

ঢাকার উত্তরার বেসরকারি চাকরিজীবী জাকির হোসেনের পরিবারে সদস্য দুজন। তাঁর আয় মাসে ৪৫ হাজার টাকা। তবে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা ঋণের কিস্তি বাবদ দিতে হয়। তিনি বলেন, ৩৫ হাজার টাকা ব্যয় করেও তাঁর সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য নেই। কারণ, খরচ মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়েছে। কিন্তু বেতন বাড়েনি।

বাড়তি ব্যয় সামলাতে কী করছেন, জানতে চাইলে জাকির হোসেন বলেন, ভ্রমণের নেশা ছিল। এখন আর বেড়াতে যান না। গরুর মাংস কেনেন না বললেই চলে। মাছও কম কেনেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের চাপ আগেও মাঝেমধ্যে এসেছে। কিন্তু গত এক বছরে শুধু নিত্যপণ্য নয়, সব ক্ষেত্রে ব্যয়টা বেড়ে যাওয়ায় চাপটা বেশি।’

সাভারের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন নাসিমা আক্তার। দুই কন্যাকে নিয়ে তাঁর সংসার। তিনি জানান, অতিরিক্ত সময়ের কাজসহ (ওভারটাইম) তাঁর মাসে আয় ১৪ হাজার টাকার মতো। দ্রব্যমূল্য, পরিবহনভাড়া ও সন্তানের পড়াশোনার পেছনে তাঁর ব্যয় বেড়েছে তিন হাজার টাকার মতো।

নাসিমা বলেন, খরচ কমাতে তিনি বাজারের ব্যয় কমিয়েছেন। ছুটির দিনে ঘুরতে যেতেন। এখন যান না।

ব্যয় বাড়ার সঙ্গে কারও কারও আয়ও বেড়েছে। তেমন একজন রাজধানীর মধুবাগের গাড়ির মিস্ত্রি মিজানুর রহমান। তিনি জানান, তাঁর আয় বেড়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে ৬ থেকে ৭ হাজার। বেশি ব্যয় বাড়ার কারণ দ্রব্যমূল্য ও পরিবারের সদস্যের অসুস্থতা।

ব্যয় কমানোর কয়েকটি উপায় জানিয়ে মিজানুর বললেন, ‘ভালো খাবার একটু কম খেয়ে পুষিয়ে নিতে চেষ্টা করি।’

পটুয়াখালীর গলাচিপার কৃষক কবির খলিফা অথবা ঢাকার মেরাদিয়ার মাস্ক বিক্রেতা আবু সালেহ—গল্পটি একই রকম। মধ্যবিত্তের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেই, নিম্নবিত্ত সংকটে, দরিদ্রের এখন পেট ভরানোই দায়। কারণ, মূল্যস্ফীতি ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে (৯.৫২ শতাংশ) উঠেছে গত আগস্টে।

সরকার এক কোটি পরিবারকে পরিবার কার্ড বা ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে ভতুর্কি মূল্যে নিত্যপণ্য দিচ্ছে। কম দামে নিম্ন আয়ের মানুষকে চাল ও আটা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর আওতা বাড়ানো জরুরি। অবশ্য জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড বাড়িয়ে দেওয়ায় সব খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরিপ বলছে, আগস্ট মাসে ৬৪ শতাংশ পরিবার খাবার কিনেছে ঋণ করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ ধরনের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি মানুষ কাটানোর চেষ্টা করে। নিম্নবিত্তের আয়ের বড় অংশ যায় খাবারের পেছনে।

তারা তখন আমিষের মতো পুষ্টিকর খাবার বাদ দিয়ে শর্করা খেতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চললে দেখা যেতে পারে যে রুগ্‌ণ শিশুর জন্ম বেড়েছে।

[প্রতিবেদন ও ইনফোগ্রাফিকস তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জসাভার, প্রতিনিধি, পটুয়াখালী]