ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানীর বঙ্গবাজার ভস্মীভূত হওয়ার এক সপ্তাহ পর গত বুধবার ব্যবসায়ীদের জন্য চৌকি পেতে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করে দেয়। পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ভবনের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ১ দশমিক ৭৯ একর জায়গায় বালু দিয়ে ও ইট বিছিয়ে অস্থায়ীভাবে ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের এই ব্যবস্থা করা হয়।
ব্যবসায়ীদের একটা অংশ অর্ধেক জায়গায় চৌকিতে ব্যবসা শুরু করলেও, বাকি অর্ধেক চৌকি ফাঁকা পড়ে আছে। এদিকে চৌকি পেতে বসা ব্যবসায়ীরা জানান, বেচাকেনা একদমই জমছে না। ঈদের পর এই ব্যবসায়ীদের পূর্ণাঙ্গ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা রয়েছে।
গতকাল সোমবার সরেজমিনে বঙ্গবাজারে গিয়ে চৌকি পেতে বসা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাথার ওপর ছাতা রাখলেও অতিরিক্ত গরমের কারণে দিনের বেলায় বসা কষ্টকর। তবু বসে থাকলেও ক্রেতা তেমন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই দিনের বেলা বিক্রি জমছে না। সন্ধ্যার পর কিছু ক্রেতা আসেন। তবে তাঁরা কেনার চেয়ে দামাদামিই বেশ করেন। অগ্নিকাণ্ডের আগে বঙ্গবাজার ছিল পোশাকের একটি বড় পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্র। কিন্তু এখন খুচরা বেচাবিক্রিতেই ভরসা। এদিকে যেসব ব্যবসায়ী চৌকি পেতে দেওয়ার আগেই যাত্রাবাড়ী-গুলিস্থান ফ্লাইওভারের নিচে রাস্তার পাশে বসেছিলেন, তাঁরা এখনো সেখানেই ব্যবসা করছেন। আবার অনেক ব্যবসায়ী চৌকি পেলেও কাপড়ের অভাবে এখনো দোকানে মালাপত্র ওঠাতে পারেননি। তাতে ফাঁকা পড়ে আছে অর্ধেকের মতো চৌকি।
জানতে চাইলে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সব ব্যবসায়ীর জন্য জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, তবে কিছু ব্যবসায়ী মালপত্রের সংকটের কারণে বসতে পারেননি। অনেকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতিতে পড়ায় বাড়িতে চলে গেছেন। জায়গা যেহেতু সবার নামে বরাদ্দ হয়েছে, সেহেতু চৌকি পেতে ব্যবসা করতে কোনো বাধা নেই।
একাধিক ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যাঁরা চৌকিতে বসে পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই বিক্রি ভালো না হওয়ায় ঈদের আগে আর মালপত্র আনবেন না। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন চৌকি পেতে দিলেও রোদের তাপ থেকে রক্ষা পেতে নিজেরাই ছাতা কিনেছেন। আবার কেউ কেউ ত্রিপল টাঙিয়েছেন। বিক্রি কম হওয়ায় বিনিয়োগ উঠে আসবে কি না এবং কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাবে কি না, সেই সংশয় থাকায় অনেকে চৌকিতে দোকান নিয়ে বসছেন না।
দোকান নিয়ে বসার চার দিনেও বিক্রি একেবারে হচ্ছে না জানান আরিফ গার্মেন্টসের কর্মী হাফিজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সকাল (গতকাল) থেকে বেলা একটা পর্যন্ত একটি পণ্যও বিক্রি করতে পারিনি। অথচ এ বছর রোজার শুরুতেও আমাদের প্রতিদিন গড়ে লাখ টাকার ওপরে বেচাকেনা হয়েছে। এমন সময় এসে পাইকারি বেচাকেনা কমলেও খুচরা বেচাকেনায় আমাদের দম ফেলার ফুরসত থাকত না। গরমের কারণে চার হাজার টাকা খরচ করে ত্রিপল টাঙিয়েছি। এই টাকাও উঠে আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। জায়গাটা ধরে রাখার জন্য বসেছি। এর বাইরে চাওয়া-পাওয়ার আর তেমন কিছু নেই।’
মাহা গার্মেন্টসের বিক্রয়কর্মী মো. আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার দিনে তিন হাজার টাকা বিক্রি করতে পেরেছি। কোনোমতে ঈদের খরচ আর দৈনন্দিন খরচ চালানোর জন্যই মালিকের নির্দেশে বসেছি। অন্যথায় গ্রামে চলে যেতাম।’
এদিকে গত বুধবার বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের চৌকি পেতে বসানোর সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়েছিল, অস্থায়ী এসব দোকানের জন্য শামিয়ানা টাঙানো হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের ব্যবস্থাও করা হবে। সরেজমিনে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, শামিয়ানা নিজেরাই টাঙিয়েছেন। বিদ্যুৎ এলেও তাতে শুধু রাতে আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা হয়েছে। প্রচণ্ড রোদের তাপের মধ্যেও সেখানে ফ্যান ব্যবহারের অনুমতি নেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগরী ও আদর্শ) মিলে মোট দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এখন এই দোকানগুলোর চিহ্ন নেই। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবাজারে সব মিলিয়ে ৩০৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোর কাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ছাড়া দোকানের মালিক-কর্মচারীদের মানবিক, মানসিক বিপর্যয়সহ ক্ষতির পরিমাণ, চাকরিহীনতার আর্থিক মাপকাঠি নিরূপণ করা দুরূহ বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।