গত বছরের ঠিক আজকের দিনে, অর্থাৎ ৪ এপ্রিলের কাকডাকা ভোরে আগুনের লেলিহান শিখায় দাউদাউ করে পুড়েছিল রাজধানীর বঙ্গবাজার। এতে ঈদের আগে নিঃস্ব হয়ে যান ব্যবসায়ীরা। ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের পর এক বছর পেরিয়ে গেল। অথচ এখনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা করার জন্য গঠিত তহবিলের টাকা বণ্টিত হয়নি। ব্যবসায়ীদের স্থায়ী পুনর্বাসন ভবন নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। তবে ভবনের কাজ শুরু হলে অস্থায়ী ভিত্তিতে বসা ব্যবসায়ীদের উঠে যেতে হবে। তাতেও ব্যবসায় আরেকটি ধাক্কা লাগবে বলে মনে করেন তাঁরা।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তার জন্য একটি উন্মুক্ত তহবিল গঠন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, বঙ্গবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম ও বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নাজমুল হুদার নামে আইএফআইসি ব্যাংকে এই হিসাব পরিচালিত হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ওই তহবিলে অনুদান দিয়েছিল। সব মিলিয়ে সেই হিসাবে জমা আছে ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কিন্তু ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এক বছর অতিবাহিত হলেও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এখনো সেই তহবিল থেকে টাকা পাননি।
এ নিয়ে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য গঠিত তহবিলের ছয় কোটির বেশি টাকা আমাদের কাছে আছে। সরকারের কাছ থেকে আরও ১৫ কোটি টাকার মতো অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ওই টাকাটা পেলে ব্যবসায়ীদের মাঝে বণ্টন করা হবে।’
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা এক বছর ধরে বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করছেন। সেখানে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হবে, এমন আশ্বাসের মধ্যে কেটে গেছে এক বছর। অবশ্য নতুন ভবন নির্মাণের বিষয়টি আলোচনায় আছে। চলতি মাসেই নতুন ভবনের উদ্বোধন হতে পারে। তখন অস্থায়ীভাবে বসা ব্যবসায়ীদের বঙ্গবাজার থেকে উঠে যেতে হবে। ব্যবসায়ীদের অনেকের দাবি, সব পুড়ে নিঃস্ব হওয়ার পর গত এক বছরে ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি তাঁরা। এর মধ্যে অন্যত্র ব্যবসা সরানো হলে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে তাঁদের। তবে এ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা প্রকাশ্যে কথা বলতে চাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্থায়ীভাবে বসার সুযোগ করে দিয়ে ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ে ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে এমন ঘটনা ঘটলে অনেক সময় দেখা যায় অনেক ব্যবসায়ী ঝরে পড়েন।’
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আগুনে পুড়ে যাওয়া ঢাকার ফুলবাড়িয়ার বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের স্থানে ১০তলা বিপণিবিতান নির্মাণ করবে তারা। বঙ্গবাজারে ১০৬ কাঠা জমির ওপর নতুন বিপণিবিতানটি নির্মাণ করতে অন্তত চার বছর সময় লাগবে। সে অনুযায়ী প্রস্তাবিত এই বিপণিবিতানের নির্মাণকাজ ২০২৮ সালে শেষ হওয়ার কথা। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬৫ কোটি টাকা। এই বিপণিবিতান নির্মাণের খরচ দোকানমালিকদের কাছ থেকে চার কিস্তিতে নেওয়া হবে।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪টি মার্কেটে মোট ২ হাজার ৯৬১টি বৈধ দোকান ছিল। বৈধ বরাদ্দপত্র ও প্রয়োজনীয় নথি দেখাতে পারলে এই মালিকদের সবাই নতুন বিপণিবিতানে দোকান পাবেন বলে জানান ডিএসসিসির কর্মকর্তারা।
নতুন বিপণিবিতানে দোকানসংখ্যা হবে ৩ হাজার ২১৫। অর্থাৎ বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের তুলনায় নতুন বিপণিবিতানে অতিরিক্ত ২৪৬টি দোকান করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। পুড়ে যাওয়া মার্কেটে দোকানের আকার ছিল সর্বনিম্ন ১৭ বর্গফুট, সর্বোচ্চ ২২ বর্গফুট। নতুন বিপণিবিতানে দোকানের আকার হবে ৮০ থেকে ১২০ বর্গফুট। দোকানের আকার বড় হওয়ার কারণে আগের মালিকদের দোকানপ্রতি গড়ে ২০ লাখ টাকার মতো সিটি করপোরেশনের তহবিলে জমা দিতে হবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঈদুল ফিতর পর্যন্ত বঙ্গবাজারে ব্যবসা পরিচালিত হবে। ঈদের পরই আমরা সেখানে নতুন মার্কেটের নির্মাণকাজে হাত দেব। যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের নতুন মার্কেটে উঠিয়ে দিতে পারব। দরপত্রের কার্যক্রম প্রায় শেষ। আমরা আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই মার্কেটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের ৪টি ইউনিটে (বঙ্গবাজার, গুলিস্তান, মহানগর ও আদর্শ) সব মিলিয়ে দোকান ছিল ২ হাজার ৯৬১টি। এ ছাড়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সে ৭৯১টি, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেটে ৫৯টি ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সে ৩৪টি দোকান আগুনে পুড়েছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৮৪৫টি দোকানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবাজারে ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে মালপত্রের ক্ষতি হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকার বেশি। আর মার্কেটগুলোয় অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এ ছাড়া দোকানের মালিক-কর্মচারীদের মানবিক, মানসিক বিপর্যয়সহ ক্ষতির পরিমাণ এবং চাকরিহীনতার আর্থিক মাপকাঠি নিরূপণ করা দুরূহ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।