গেল ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে যাঁরাই বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই চেয়েছেন বিভিন্ন সেবা খাতে বিনিয়োগ করতে।
বাংলাদেশে যাঁরাই পুঁজি বিনিয়োগে আগ্রহী, তাঁদের বেশির ভাগই বিনিয়োগ করতে চান সেবা খাতে। সরকারের কাছে দেওয়া দেশি, বিদেশি কিংবা যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিনিয়োগকারীরা সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন সেবা খাত হিসেবে চিহ্নিত বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে।
গত ২০২১–২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মাধ্যমে মোট ১ হাজার ১২৪টি বিনিয়োগ প্রকল্প নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশিই সেবা খাতের। এ ক্ষেত্রে দেশি বিনিয়োগকারীদের চেয়ে বরং বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেশি ছিল।
বিডার তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরে যত দেশীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয়েছে, তার ৪৩ শতাংশই করা হয়েছে সেবা খাতে। অন্যদিকে সেবা খাতে বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাবের হার ছিল এ খাতে করা প্রস্তাবের অর্ধেকের বেশি বা ৫১ শতাংশ।
জাতীয় শিল্পনীতি ২০২২ অনুসারে, অটোমোবাইল, এভিয়েশন, পরিবহন, যোগাযোগ, ওয়্যারহাউস, সুপারশপ, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, লজিস্টিক, বিভিন্ন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদিকে সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সেবা খাতের অবদান এখন ৫১ শতাংশের বেশি। ফলে দেখা যাচ্ছে, শিল্প উৎপাদন খাতের তুলনায় সেবা খাত ঘিরে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে।
বিডার তথ্যানুযায়ী, গত অর্থবছরে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা সেবা খাতের পর রাসায়নিক (২০ শতাংশ), বস্ত্র (১৫ শতাংশ), ইঞ্জিনিয়ারিং (১০ শতাংশ) ও কৃষি (৪ শতাংশ) খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে ২০২১–২২ অর্থবছরে সেবা খাতের পর বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ছিল রাসায়নিকে (১৪ শতাংশ), ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (১৪ শতাংশ), বস্ত্র (৮ শতাংশ) ও কৃষি খাতে (৪ শতাংশ)। এ ছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, প্রিন্টিং, ট্যানারি ও চামড়া, গ্লাস ও সিরামিক ইত্যাদি খাতেও বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে গত অর্থবছরে।
এর আগের তিন অর্থবছরেও বিডাতে সেবা খাতে বিনিয়োগ প্রস্তাব তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। যেমন ২০২০–২১ অর্থবছরে বিডায় নিবন্ধিত স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাবের মধ্যে সেবা খাতে বিনিয়োগ প্রস্তাব ছিল ১২ শতাংশ এবং বিদেশি ও যৌথ প্রকল্প প্রস্তাব ৭৩ শতাংশ। ২০১৯–২০ অর্থবছরে ৪৭ শতাংশ ও ২০১৮–১৯ অর্থবছরে ১৪ শতাংশ স্থানীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব করা হয় সেবা খাতের জন্য। তবে এই দুই অর্থবছরে সেবা খাতে বিদেশি ও যৌথ বিনিয়োগ প্রস্তাব ৪ শতাংশের কম ছিল।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, বিডার মাধ্যমে সেবা খাতে বিনিয়োগ প্রস্তাব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সেবা খাতে বিনিয়োগ প্রস্তাব যেমন বাড়ছে, প্রকৃত বিনিয়োগও বাড়ছে বলে ধারণা করছেন কর্মকর্তারা।
ফলে এখন মোট দেশজ উৎপাদনেও (জিডিপি) সেবা খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০২০–২১ অর্থবছরে জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ছিল ৫১ শতাংশের বেশি। এর আগের ছয় অর্থবছরেও জিডিপিতে সেবা খাতের অবদান ৫০ শতাংশের বেশি হিসাব করা হয়েছে।
টাকার হিসাবে সাধারণত শিল্প খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি হয়, বেশি হয় কর্মসংস্থানও। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে সেবা খাতে বিনিয়োগে আগ্রহ বেশি কেন, এমন প্রশ্নে ব্যবসায়ীরা বলছেন, শিল্প খাতে তুলনামূলক বেশি মুনাফা হলেও জটিলতা অনেক বেশি। সে তুলনায় সেবা খাতে অনেক কম জটিলতায় ব্যবসা করা যায়।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, উৎপাদন খাতের ব্যবসায় নিবন্ধন থেকে শুরু করে প্রতি ধাপে একজন ব্যবসায়ীকে নানা ধরনের জটিলতার মুখে পড়তে হয় এবং সেই সব জটিলতা পার হয়ে তাঁকে একটি শিল্প স্থাপন করতে হয়।
‘সেই তুলনায় সেবা খাতের ব্যবসায় জটিলতা অনেক কম থাকে। সেবা খাতগুলোকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিচালনা করাও অনেক সহজ,’ প্রথম আলোকে বলেন এই ব্যবসায়ী।
বিডার তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে বিডার মাধ্যমে ১ হাজার ২৮টি বিনিয়োগ প্রকল্পের প্রস্তাব আসে, যা এর আগের বছরের তুলনায় ১৮৯টি বা ২২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য সরকারের কাছ থেকে যে নিবন্ধন নিতে হয়, তার পরিমাণ বাড়ছে।
টাকার অঙ্কে হিসাব করলে আরেকটু ভালো ধারণা পাওয়া যায়। গত বছর বিডায় ৪৬ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব আসে। আর ২০২১ সালে বিনিয়োগ প্রস্তাবের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকার। অর্থাৎ ১ বছরে ১৫ শতাংশ বা ৬ হাজার ২০৯ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব বেশি এসেছে। সব মিলিয়ে গত ৪ বছরে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যা গড়ে ১৫ শতাংশের বেশি হারে বেড়েছে।
বিডার কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও করোনা মহামারির কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা প্রতিকূলে থাকলেও দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ অনুকূলে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন বিনিয়োগে আগ্রহী হন, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এতে বিনিয়োগ প্রস্তাবের সংখ্যাও আগের তুলনায় বাড়ছে।’
তবে বিডার বিনিয়োগের এ হিসাব দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, হাইটেক পার্ক এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) খাত ছাড়া অন্যান্য বেসরকারি খাতের।
অন্যদিকে নিবন্ধিত এসব বিনিয়োগ প্রস্তাবকে কখনো চূড়ান্ত বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কারণ, যাঁরা বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়ে নিবন্ধন নেন, পরে তাঁদের একটা বড় অংশই বিভিন্ন বাস্তবতায় আর বিনিয়োগ করেন না।
বিডার মাধ্যমে যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব নিবন্ধিত হয়, তার মধ্যে শেষ পর্যন্ত কতগুলো বাস্তবায়িত হয়, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য বিডার কাছে আপাতত নেই।
বিডার নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন জানান, বিনিয়োগের বাস্তব অবস্থা যাচাইয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট জরিপ করা হয়নি। ফলে যাঁরা এখানে বিনিয়োগ করতে আসেন, তাঁদের অগ্রগতি নথিবদ্ধ করা যায় না। তবে এটা নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ নিবন্ধনের পরিমাণ বাড়লেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, দেশে ব্যবসা সহজীকরণের জন্য সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, মাঠপর্যায়ে তার বাস্তবায়ন ঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ হচ্ছে কম। আর বড় ধরনের বিদেশি বিনিয়োগও তেমন আসছে না।
ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি এবং এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান বলেন, ‘খাতা–কলমে আমরা যেসব সুবিধা দেখি, বাস্তবে তেমনটা পাওয়া যায় না। প্রতিযোগী দেশগুলো বিনিয়োগ সুবিধা বাস্তবায়নের দিক থেকে অনেক এগিয়ে আছে। এ জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে পিছিয়ে পড়ছি আমরা।