হিনডেনবার্গ প্রতিবেদনের জের

আদানি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থাগুলো

আদানি সাম্রাজ্যের কর্নধার গৌতম আদানি
ছবি: এএফপি

এমন বিপদে বোধ হয় আর পড়েননি ভারতের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানি। হিনডেনবার্গ প্রতিবেদনের জেরে গত ১১ দিনের ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে তাঁর সাজানো বাগান। এবার আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থাগুলোও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। এর প্রভাবে বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় বাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে সতর্ক হতে পারে বলে আশঙ্কা।

গতকাল শুক্রবার আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল রেটিংস জানিয়েছে, আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কে সামগ্রিক মূল্যায়ন তারা অপরিবর্তিত রাখলেও আদানি পোর্টস ও আদানি ইলেকট্রিসিটি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে তারা—স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক। এর অর্থ হলো, ভবিষ্যতে আদানি গোষ্ঠীর মূল্যায়ন হ্রাসের আশঙ্কা। মুডিস ইনভেস্টরস সার্ভিস বলেছে, শেয়ার দরের পতন হওয়ার কারণে আদানি গোষ্ঠীর কোম্পানিগুলোর পুঁজি সংগ্রহের সক্ষমতা কমবে। এ ছাড়া ফিচ রেটিংসের মূল্যায়নে এখনই কোনো বদল না হলেও পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে তারা। খবর রয়টার্সের।

বিবৃতিতে মুডিস বলেছে, ‘আদানি গোষ্ঠীর যেসব কোম্পানি রেটিংয়ের আওতায় আছে, তাদের আর্থিক পরিস্থিতে নজর রাখা হচ্ছে।’ তাদের বক্তব্য, আদানি পোর্টস, আদানি গ্রিন, আদানি ট্রান্সমিশনের নগদের অর্থের প্রবাহ ও বাজার হিস্যা সন্তোষজনক। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলির জেরে আদানি গোষ্ঠীর মূলধনী ব্যয় এবং আগামী দু-এক বছরের জন্য তার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ধাক্কা খাবে। ফিচ অবশ্য জানিয়েছে, এখনই আদানি গোষ্ঠীর মূল্যায়নে প্রভাব পড়ার তেমন সম্ভাবনা নেই। তবে কোম্পানিগুলোর পুঁজি ও তা সংগ্রহের ব্যয়ের দিকে নজর রাখা হবে।

এ ছাড়া এসঅ্যান্ডপি জানিয়েছে, তারা আদানি গোষ্ঠী সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছে, গোষ্ঠীটির পরিচালন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ তার চেয়ে অনেকটাই বেশি। বাজারের এই পরিস্থিতির কারণে তাদের মূলধন সংগ্রহ কঠিন হয়ে পড়বে এবং তার খরচ বাড়াবে। সে কারণেই আদানির দুই কোম্পানি সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি কমাচ্ছে তারা। তবে কোম্পানিগুলোর ব্যবসার ভিত শক্ত হওয়ায় মূল্যায়ন অপরিবর্তিত রেখেছে তারা।

ভারতের বিভিন্ন সরকারি করপোরেশন ও বড় বড় কোম্পানিতে বিনিয়োগ আছে আদানি গোষ্ঠীর। এই পরিস্থিতিতে সেই কোম্পানিগুলোও কিছুটা উদ্বিগ্ন। সিঙ্গাপুরভিত্তিক স্যাক্সো মার্কেটসের কৌশলবিদ চারু চান্না রয়টার্সকে বলেন, একধরনের ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে, তবে এখনো তা ব্যাংক খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় শেয়ার বাজারকে অতিমূল্যায়িত বিবেচনা করতে পারেন। ঝুঁকি কমাতে তাঁরা বিনিয়োগ থেকে পিছপা হতে পারেন।

কিন্তু ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ অবশ্য তেমনটা মনে করেন না। নেটওয়ার্ক ১৮–কে তিনি বলেন, ‘এটা একটা ঘটনামাত্র, যদিও সারা পৃথিবীতে এ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে... কিন্তু এক ঘটনা দিয়ে নিশ্চয়ই বোঝা যায় না, ভারতের শেয়ারবাজারে সুশাসন ঠিক কতটা আছে।’

এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) বলেছে, ভারতের ব্যাংকিং খাত এখনো স্থিতিশীল এবং যেকোনো ধাক্কা মোকাবিলার মতো শক্তি তার আছে। আদানি গোষ্ঠীর বড় ঋণ আছে স্টেট ব্যাংকে। তারা বলেছে, এই ঋণের বিষয়ে তারা এখনো উদ্বিগ্ন নয়। তবে পরবর্তী ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের পরিস্থিতি যাচাই-বাছাই করা হবে।

যাবতীয় আশঙ্কা আর সংশয়ের মধ্যে আদানি পোর্টস, এন্টারপ্রাইজেসসহ গোষ্ঠীটির চারটি কোম্পানির শেয়ারের দর গতকাল শুক্রবার কিছুটা বেড়েছে। তবে বাকি কোম্পানিগুলোর বিপর্যয় অব্যাহত আছে। তবে গতকাল সামগ্রিকভাবে ভারতের শেয়ারবাজারে সূচকের বিপুল উত্থান হয়েছে।

গতকাল সেনসেক্স ৯০৯ দশমিক ৬৪ পয়েন্ট বেড়ে ৬০ হাজার ৮৪১ দশমিক ৮৮ অঙ্কে উঠে যায়। নিফটি ২৪৩ দশমিক ৬৫ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ হাজার ৮৫৪ দশমিক ০৫। আর তার মধ্যে দাঁড়িয়েই আদানি ট্রান্সমিশন, আদানি গ্রিন এনার্জি, আদানি পাওয়ার, আদানি টোটাল গ্যাস, আদানি উইলমার, এনডিটিভির শেয়ারের দাম আরও মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে।

গতকাল শুক্রবার আদানি গোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর বাজার মূলধন ছিল ১০৭ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৭৫০ কোটি ডলার। প্রতিবেদন প্রকাশের আগে যা ছিল ২১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ১০ দিনে তা অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে।

তদন্ত শুরু

এ দিকে ভারতের বিরোধী রাজনীতিকদের দাবির মুখে গৌতম আদানির কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে দেশটির করপোরেট–বিষয়ক মন্ত্রণালয়। শুক্রবার সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে উদ্ধৃত করে ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে।

গত কয়েক বছরে আদানি গোষ্ঠীর যাবতীয় আর্থিক প্রতিবেদেন ও অন্যান্য ব্যবসায়িক লেনদেনের হিসাব পরীক্ষা করছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।

ঝড় শুরু হয় ২৪ জানুয়ারি

২৪ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারসংক্রান্ত গবেষণা সংস্থা হিনডেনবার্গ রিসার্চ দাবি করে, এক দশক ধরে শেয়ারের দরে জালিয়াতি করে আসছে আদানি গোষ্ঠী। ২৪ জানুয়ারি ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই আদানিদের ১০টি সংস্থার শেয়ারে ধস নামে। এর প্রতিক্রিয়ায় ৪১৩ পৃষ্ঠার জবাব দেয় আদানি গোষ্ঠী। তাদের অভিযোগ, হিনডেনবার্গ স্বল্পমেয়াদি মুনাফার জন্য এই প্রতিবেদনে দিয়েছে। এটা ভারতের অগ্রগতি রোখার চক্রান্ত। তবে আদানিদের এই বিবৃতি হালে পানি পায়নি; বরং হিনডেনবার্গ পাল্টা বলে, আদানিরা ভারতীয় পতাকায় শরীর মুড়িয়ে দেশ লুট করেছেন।