ডলার–সংকটে দর বাড়ছেই

আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম দিতে হচ্ছে ১০২ টাকা। খোলাবাজারে প্রতি ডলার ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা।

আমদানি খরচ বৃদ্ধির ফলে ডলারের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছে, তা শিগগিরই কাটছে না। কারণ, নানা উদ্যোগের পরও আমদানি খরচ সেভাবে কমানো যাচ্ছে না। আবার প্রবাসী আয়েও সুখবর নেই। ফলে আমদানি দায় মেটাতে ব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম দিতে হচ্ছে ১০২ টাকা।

এর মধ্যে নানা দেশে মন্দার পদধ্বনি শুরু হয়েছে। এতে রপ্তানি আদেশ কমে যাচ্ছে, আবার বাড়ছে উৎপাদন খরচ। এর মধ্যে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়েছে। যে কারণে শিল্প এলাকার বাইরে অবস্থিত কারখানাগুলো বিভিন্ন সময়ে বন্ধ রাখতে হচ্ছে।

এ রকম এক পরিস্থিতিতে গতকাল রোববার দেশের মানি চেঞ্জার ও খোলাবাজারে ডলারের দামে রেকর্ড হয়েছে। প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা। এর ফলে বিদেশগামী যাত্রী, রোগী, ভ্রমণ ও শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাওয়া নাগরিকদের ডলার কিনতে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে, যা তাঁদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে। কারণ, এমনিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রপ্তানি আয় বাড়াতে ডলারের দাম বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ডলার খরচ করে যেসব কম গুরুত্বপূর্ণ বড় প্রকল্প হচ্ছে, তাতেও ধীরে চলা নীতি নিতে হবে।

ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশেই এই সংকট চলছে। বাংলাদেশে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। বিলাসপণ্যের ঋণপত্র খোলা কমছে।
খন্দকার রাশেদ মাকসুদ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

ডলার–সংকট কেন

বাংলাদেশে ডলারের সংকট শুরু হয় গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়ে। ওই সময়ে ডলারের দাম ধরে রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে আয় পাঠাতে অবৈধ পথ বেছে নেন অনেক প্রবাসী। ওই সময় কিছু আমদানিকারক আমদানি দায় পরিশোধের সময় ছয় মাস পিছিয়ে দেন, যা পরিশোধের সময় হয় চলতি বছরের মে মাসে। তবে মে মাসে দেশে প্রবাসী আয় কমে যায়।

আবার জ্বালানি তেল, ভোগ্যপণ্য ও জাহাজভাড়া বেড়ে যায়। এর ফলে ডলারের সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংক এক মাসের ব্যবধানে ডলারের দাম আড়াই টাকা বৃদ্ধি করে। এপ্রিলের শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে আন্তব্যাংক ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা, যা মে মাস শেষে বেড়ে হয় ৮৯ টাকা। এই সময়ে ব্যাংকগুলোর মধ্যে ডলার বেচাকেনাও বন্ধ হয়ে যায়।

আর গত জুন মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ডলারের দাম বেড়ে হয় ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা, যা গত বুধবার বেড়ে হয় ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা। তবে ব্যাংকগুলো রপ্তানি ও প্রবাসী আয় আনছে ১০১-১০২ টাকা দরে। ফলে আমদানিকারকদের বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে পণ্যের দামে।

স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার রাশেদ মাকসুদ এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশে নয়, অনেক দেশেই এই সংকট চলছে। বাংলাদেশে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার প্রভাব পড়তে সময় লাগবে। বিলাসপণ্যের ঋণপত্র খোলা কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমছে, এর প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আমদানির চাপ কিছুটা কমবে। তবে খুব বেশি না। এখন প্রবাসী আয় বাড়াতে নজর বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রণোদনা আরও বাড়ানো যেতে পারে।
মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম, অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

যত উদ্যোগ

ডলার–সংকট প্রকট হলে গত মে মাসে বিদেশ থেকে ডলার আনার প্রক্রিয়া উদার করে দেওয়া হয়। আগে পাঁচ হাজার ডলারের বেশি পাঠালে আয়ের নথিপত্র জমা দিতে হতো। ফলে প্রবাসী আয় বাবদ দেশে যত পরিমাণ ডলার পাঠানো হোক না কেন, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করছে না এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো। এর বিপরীতে আড়াই শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। এরপরও জুন মাসে আয় কমে যায়। কোরবানির ঈদেও তেমন আয় আসেনি।

সংকট কাটাতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ সফর বন্ধ করে দেয় সরকার। আর ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও সংকট না কাটলে প্রবাসী আয় সংগ্রহের ক্ষেত্রে এক দর বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকে কত দামে রপ্তানি বিল নগদায়ন হবে ও আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করবে, তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে সিদ্ধান্তটি অবাস্তব হওয়ায় তা প্রত্যাহার করে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এরপর ব্যাংকগুলোর ডলারের দাম ও কী পরিমাণ ডলার ধারণ করেছে, তা পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে ধরা পড়ে, অনেক ব্যাংক সীমার বেশি ডলার ধারণ করছে। কেউ বেশি দামে ডলার কিনে আরও বেশি দামে বিক্রি করছে। এভাবে অস্বাভাবিক মুনাফা করেছে দেশি-বিদেশি কয়েকটি ব্যাংক। এরপর সংকট কেটে যাওয়ার আশা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, তবে আমদানি দায়ের চাপে তা আরও প্রকট হয়।

এরপর জুন মাসে এক সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডলারের মূল্য ৯৩ টাকার ওপরে যাবে না। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সংযত হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকই ডলারের দাম সবশেষ ৯৪ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করেছে।

‘বাজারে ডলারের সংকট, অন্যদিকে চাহিদা অত্যধিক বেশি। প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ ডলারের চাহিদা আসছে। এতে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বাড়ছে। গতকাল প্রতি ডলার ১০৩ থেকে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। ডলার কিনেছি ১০৩ টাকা ৫০ পয়সায়।’
হুমায়ূন কবির, রাজধানীর গুলশানের খান অ্যান্ড মানি চেঞ্জারের মালিক

এমন পরিস্থিতিতে চলমান ডলার–সংকট ঠেকাতে দামি গাড়ি, প্রসাধনী, স্বর্ণালংকার, তৈরি পোশাক, গৃহস্থালি বৈদ্যুতিক সামগ্রী বা হোম অ্যাপ্লায়েন্স, পানীয়সহ ২৭ ধরনের পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে আমদানি পর্যায়ে কড়াকড়ি আরোপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণ বন্ধ করে দেয়।

এরপর ডলার-সংকট নিরসনে চারটি সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সেগুলো হলো ব্যাংকের ডলার ধারণের সীমা (এনওপি) হ্রাস, রপ্তানিকারকের প্রত্যাবাসন কোটায় (ইআরকিউ) ধারণকৃত ডলারের ৫০ শতাংশ নগদায়ন, ইআরকিউ হিসাবে জমা রাখার সীমা কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়ে আনা এবং অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং ইউনিটে স্থানান্তর।

এ ছাড়া ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের বেসরকারি যেকোনো আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। এর ফলে এখন আমদানি তদারকি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আটকেও দিচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি ডলার খরচ করে জাহাজ আমদানির ঋণপত্র আটকে দিয়েছে। পাশাপাশি রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রি করছে। ফলে রিজার্ভ ৪৬ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন,যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আমদানির চাপ কিছুটা কমবে। তবে খুব বেশি না। এখন প্রবাসী আয় বাড়াতে নজর বাড়াতে হবে। এ জন্য প্রণোদনা আরও বাড়ানো যেতে পারে।

খোলাবাজার পরিস্থিতি

ব্যাংক খাতের পাশাপাশি খোলাবাজারেও ডলারের দাম এখন চড়া। পাশাপাশি দুবাই, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইউরোপসহ কয়েকটি দেশের মুদ্রার দামও বেশ চড়া। খোলাবাজারে গতকাল ডলার ১০৩ টাকার বেশি দামে কেনাবেচা হয়েছে। প্রতি ডলার ১০৩ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সায় কেনাবেচা হয়েছে।

গুলশানের রাতুল মানি চেঞ্জারের কর্ণধার সাইফুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০৪ টাকা ৪০ পয়সা দামে ১০ হাজার ডলার কিনেছিলাম। বিক্রি করেছি ৩ হাজার ডলার। ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ৮০ পয়সা পর্যন্ত দামে বিক্রি করেছি।’

খোলাবাজারে হঠাৎ ডলার চড়া হয়ে যাওয়ার কারণ বলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। সাধারণত কেউ পাচারের জন্য বড় অঙ্কের ডলার সংগ্রহ করলে সংকট হয়, এ জন্য দাম বেড়ে যায়। এবারও তা–ই হয়েছে বলে মনে করছেন ডলার ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর গুলশানের খান অ্যান্ড মানি চেঞ্জারের মালিক হুমায়ূন কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে ডলারের সংকট, অন্যদিকে চাহিদা অত্যধিক বেশি। প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ ডলারের চাহিদা আসছে। এতে প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বাড়ছে। গতকাল প্রতি ডলার ১০৩ থেকে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত বিক্রি করেছি। ডলার কিনেছি ১০৩ টাকা ৫০ পয়সায়।’

খোলাবাজার ও মানি চেঞ্জারগুলো সাধারণত বিদেশফেরত ও সংগ্রহে থাকা ডলার ক্রয় করে। ব্যাংকের রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের সঙ্গে এই বাজারের সম্পর্ক নেই।