দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত নিম্নমানের কোম্পানির সংখ্যা আরও বেড়েছে। একসঙ্গে ২৮ কোম্পানিকে নতুন করে জেড শ্রেণিভুক্ত করেছে ডিএসই। এর ফলে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় এক–পঞ্চমাংশ এখন ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনা মেনে এসব কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসই। নতুন এ সিদ্ধান্ত আজ বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে। এতে জেড শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ৫৬ থেকে বেড়ে ৮৪টিতে উন্নীত হবে, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ২১ শতাংশ। বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজারে মোট তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডের সংখ্যা ৩৯৭টি।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির প্রায় এক–পঞ্চমাংশ জেড বা দুর্বল শ্রেণির হওয়ার ঘটনাকে বাজারের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্তব্য করেছেন বাজারসংশ্লিষ্টরা। তাঁরা বলছেন, গত ১৫ বছরে একের পর এক মানহীন কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির অনুমোদন দেওয়াতেই এমন হয়েছে। বিএসইসির আগের দুই কমিশন এমন অনেক কোম্পানিকে বাজারে এনেছে, যেগুলো কোনোভাবেই উপযুক্ত ছিল না।
* ভালো মানের ‘এ’ শ্রেণি থেকে বাদ পড়ছে ৫ কোম্পানি।* ২৩ কোম্পানি ‘বি’ শ্রেণি থেকে জেড শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে।* বিএসইসির আগের কমিশন জেড শ্রেণির নিয়ম পরিপালন আটকে দিয়েছিল।
এ বিষয়ে ব্রোকারেজ হাউস প্রাইম ব্যাংক সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিগত দুই কমিশন দুর্বল ও মানহীন অনেক কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে এনেছে। ফলে তালিকাভুক্তির কয়েক বছর না যেতেই এগুলো নামসর্বস্ব কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের বাজারে তালিকাচ্যুতির ব্যবস্থাও নেই। তাই বছরের পর বছর দুর্বল মানের কোম্পানিগুলো কারসাজির হাতিয়ার হয়ে বাজারে থেকে যাচ্ছে। এটি সার্বিকভাবে বাজারে সুশাসনের পরিপন্থী।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে মো. মনিরুজ্জামান কোনো কোম্পানিকে বাজারে আনার ক্ষেত্রে সেটির বিক্রয় ও মূলধন বিনিয়োগের বিপরীতে রিটার্নের একটি সীমা নির্ধারণের পরামর্শ দেন।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন মানদণ্ডের ভিত্তিতে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। এসব শ্রেণি হচ্ছে এ, বি, জি, এন এবং জেড। এর মধ্যে যেসব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় (১০ শতাংশের বেশি), নিয়মিত সাধারণ সভা (এজিএম) করে, সেগুলোকে ভালো মানের কোম্পানি হিসেবে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। যেসব কোম্পানি ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেয়, সেগুলোকে মাঝারি মানের কোম্পানি বিবেচনায় ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। আর ‘এন’ শ্রেণিভুক্ত করা হয় নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে। যেসব কোম্পানি বিনিয়োগকারীদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেয় না, নিয়মিত এজিএম করে না এবং বন্ধ বা লোকসানি, সেগুলোকে ‘জেড’ শ্রেণিতে রাখা হয়। এর বাইরে যেসব কোম্পানি উৎপাদন শুরুর আগে শেয়ারবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের অনুমোদন পায়, সেগুলো ‘জি’ শ্রেণিভুক্ত হয়। এখন অবশ্য ‘জি’ শ্রেণিভুক্ত কোনো কোম্পানি নেই।
গত ২০ মে বিএসইসি জেড শ্রেণি নিয়ে একটি নির্দেশনা জারি করে। এতে বলা হয়, পরপর দুই বছর বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ না দিলে, আইন অনুযায়ী নিয়মিত এজিএম না করলে, সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া ছয় মাসের বেশি উৎপাদন বা কার্যক্রম বন্ধ থাকলে, পুঞ্জীভূত লোকসান পরিশোধিত মূলধনের বেশি হলে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঘোষিত লভ্যাংশের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ বিতরণ না করলে কোনো কোম্পানিকে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত করা যাবে।
ওই নির্দেশনা জারির পর জেড শ্রেণির নতুন তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয় ডিএসই। সেটি করলে একসঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কোম্পানি দুর্বল শ্রেণিভুক্ত হবে—এমন যুক্তিতে ডিএসইকে নির্দেশনাটি পরিপালনে বিরত থাকতে মৌখিকভাবে নির্দেশ দেয় বিএসইসি। ফলে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিএসইসির নেতৃত্বেও বদল আসে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নতুন নেতৃত্ব তথা কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্বল মানের ২৮ কোম্পানিকে জেড শ্রেণিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় ডিএসই, যা আজ বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে।
নতুন করে যে ২৮ কোম্পানি জেড শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে—অ্যাসোসিয়েটড অক্সিজেন লিমিটেড (এওএল), ইন্দো–বাংলা ফার্মাসিউটিক্যালস, বিচহ্যাচারি, দেশ গার্মেন্টস, এডভেন্ট ফার্মা, খুলনা পাওয়ার, প্যাসিফিক ডেনিমস, ফরচুন শুজ, এনার্জি পাওয়ার জেনারেশন, ভিএফএস থ্রেড ডায়িং, শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, এসকে ট্রিমস, লুব–রেফ বাংলাদেশ, লিবরা ইনফিউশন, ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, ফনিক্স ফাইন্যান্স, অলিম্পিক এক্সেসরিজ, ন্যাশনাল টিউবস, ন্যাশনাল ব্যাংক, মিরাকেল ইন্ডাস্ট্রিজ, জিএসপি ফাইন্যান্স, ফার কেমিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মা, বিডি থাই, বে লিজিং, এটলাস বাংলাদেশ, আনলিমা ইয়ার্ন ও ইউনিয়ন ইনস্যুরেন্স।
নতুন করে জেড শ্রেণিতে স্থানান্তরিত ২৮ কোম্পানির মধ্যে পাঁচটি কোম্পানি ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত। বাকি ২৩টি ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত। এ শ্রেণি থেকে জেড শ্রেণিতে যাচ্ছে অ্যাসোসিয়েটড অক্সিজেন, খুলনা পাওয়ার, ফনিক্স ফিন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও বে লিজিং। এর মধ্যে ফনিক্স ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স ও বে লিজিং পরপর দুই বছর লভ্যাংশ ঘোষণায় ব্যর্থ হয়েছে। এ কারণে কোম্পানি তিনটিকে বিএসইসির নির্দেশনা মেনে জেড শ্রেণিতে স্থানান্তর করা হচ্ছে। আর অ্যাসোসিয়েটড অক্সিজেন ও খুলনা পাওয়ার নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ঘোষিত লভ্যাংশের ৮০ শতাংশ অর্থ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিতরণে ব্যর্থতার দায়ে জেড শ্রেণিভুক্ত হচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী, দুর্বল মানের অর্থাৎ জেড শ্রেণির শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে কোনো ঋণসুবিধা পাওয়া যায় না। নগদ টাকায় এসব কোম্পানির শেয়ার কিনতে হয়। আবার জেড শ্রেণির কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তিতেও বাড়তি সময় লাগে। বর্তমানে জেড শ্রেণির শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তিতে সময় লাগে তিন কার্যদিবস। অর্থাৎ একজন বিনিয়োগকারী যেদিন এই শেয়ার কেনেন তার চতুর্থ দিনে গিয়ে সেটির লেনদেন সম্পন্ন হয়। মূলত এ ধরনের শেয়ার কেনায় বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করতেই এ রকম বিধান করা হয়েছে।