দেশের শেয়ারবাজারে বর্তমানে অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় ঘুরেফিরে বিনিয়োগকারীদের আলোচনায় আসছে। সেটি হলো তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শ্রেণীকরণ বা শ্রেণি মান।
বর্তমানে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড ও বন্ডের জন্য পাঁচটি শ্রেণি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে ‘এ’, ‘বি’, ‘জি’, ‘এন’ ও ‘জেড’। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৯৭টি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিদ্যমান এসব শ্রেণি মান বা শ্রেণিতে বিভক্ত।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) মোট তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫৭। এর মধ্যে সরকারি ট্রেজারি বন্ড ২৩৬টি, করপোরেট বন্ড ১৬টি ও ডিবেঞ্চার বা ঋণ উপকরণ ৮টি। সব মিলিয়ে বাজারে তালিকাভুক্ত বিভিন্ন ধরনের বন্ড ও ডিবেঞ্চারের সংখ্যা ২৬০। এসব বন্ড ও ডিবেঞ্চারকে শেয়ারবাজারে কোনো শ্রেণি মানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এই ২৬০টি বন্ড ও ডিবেঞ্চার বাদ দিয়ে বাকি ৩৯৭টি কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডকে বিদ্যমান পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে।
শ্রেণি মানের শুরু
দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডকে বিভিন্ন শ্রেণি মানে বিভক্ত করার প্রক্রিয়াটি প্রথম শুরু হয় ২০০০ সালে। ডিএসইর তৎকালীন নেতৃত্ব ওই বছরের ২ জুলাই প্রথমবারের মতো তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শ্রেণীকরণের জন্য ‘এ’ ও ‘বি’ শ্রেণি নামে আলাদা দুটি শ্রেণি বা ক্যাটাগরি চালু করে। এরপর একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর চালু করা হয় ‘জেড’ শ্রেণি। ২০০২ সালের ৩০ জুন চালু করা হয় ‘জি’ শ্রেণি। আর সর্বশেষ ২০০৬ সালের ৩ জুলাই থেকে চালু করা হয়েছিল নতুন আরেক শ্রেণি ‘এন’। এই শ্রেণি মান চালুর বিষয়ে বলা হয়, তালিকাভুক্ত কোম্পানির আর্থিক ভিত্তি ও কার্যক্রম সম্পর্কে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সুস্পষ্ট ধারণা দিতে শ্রেণি দুটি চালু করা হয়েছে; যাতে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা সহায়ক হয়।
কোন শ্রেণির কী মান
২০০০ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে মোট পাঁচটি শ্রেণি মান চালুর পাশাপাশি এসব শ্রেণি মান নির্ধারণের ক্ষেত্রে কিছু মানদণ্ডও ঠিক করে ডিএসইর পরিচালনা পর্ষদ। এসব মানদণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানি নিয়মিত বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম) করবে এবং আর্থিক বছর শেষে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে লভ্যাংশ দেবে, সেসব কোম্পানিকে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত করা হবে।
যেসব কোম্পানি নিয়মিত এজিএম করবে, কিন্তু ১০ শতাংশের কম লভ্যাংশ দেবে, তাদের ‘বি’ শ্রেণিতে রাখা হবে। নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে ‘এন’ শ্রেণি এবং গ্রিনফিল্ড কোম্পানি তথা যেসব কোম্পানি উৎপাদনে আসার আগে তালিকাভুক্ত হবে, সেগুলোকে ‘জি’ শ্রেণিভুক্ত করা হবে। আর যেসব কোম্পানি নিয়মিত এজিএম করবে না, বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেবে না, টানা ছয় মাসের বেশি যাদের উৎপাদন বন্ধ থাকবে, সেসব কোম্পানির জন্য চালু করা হয় ‘জেড’ শ্রেণি।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য এই শ্রেণি বিভাজন তৈরির পেছনে মূলত দুটি কারণ কাজ করেছিল। প্রথম কারণটি ছিল, বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ভালো ও মন্দ কোম্পানি বাছাইয়ে সহায়তা করা। দ্বিতীয় কারণটি হলো, শেয়ারের বিপরীতে ঋণদাতা ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে কোম্পানি বাছাই।
শেয়ারবাজারের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ‘এ’, ‘বি’, ‘এন’ ও ‘জি’ শ্রেণিভুক্ত শেয়ারে ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। তবে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে শুধু এসব শ্রেণিভুক্ত হলেই ঋণ পাওয়া যায় না। আরও কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে কোম্পানির মূল্য আয় অনুপাত বা পিই রেশিও হতে হবে ৪০-এর নিচে। আর নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও শ্রেণি বদলের ক্ষেত্রে প্রথম ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে ঋণসুবিধা বন্ধ থাকবে।
শ্রেণীকরণের নেপথ্যে
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে নানা শ্রেণিতে ভাগ করার সুপারিশটি আসে ঢাকা চেম্বারের এক আলোচনায়। শেয়ারবাজার নিয়ে আয়োজিত ওই আলোচনা সভায় সংগঠনটির একজন গবেষণা কর্মকর্তা তাঁর প্রবন্ধে এই সুপারিশ তুলে ধরেন। সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তৎকালীন কর্মকর্তা ফরহাদ আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা চেম্বারের ওই সভায় শেয়ারবাজারের কোম্পানিগুলো নিয়ে শ্রেণীকরণের সুপারিশ তুলে ধরা হলে শেয়ারবাজার–সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ সেটিকে গ্রহণ করে। তার ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন শ্রেণীকরণ করা হয়।
ইংরেজি বর্ণমালার প্রথম বর্ণ দিয়ে এই শ্রেণীকরণের শুরু। ‘এ’ বর্ণ দিয়ে যেহেতু ইংরেজি বর্ণমালার শুরু, তাই সবচেয়ে ভালো কোম্পানি বোঝাতে ‘এ’ শ্রেণি নির্ধারণ করা হয়। আর ‘এ’-এর চেয়ে একটু খারাপ বোঝাতে বেছে নেওয়া হয় ‘বি’ বর্ণটিকে। শেয়ারবাজারে ‘বি’ শ্রেণি দিয়ে বোঝানো হয় ‘এ’ শ্রেণির চেয়ে কিছুটা খারাপ মানের কোম্পানি। ‘এন’ শ্রেণিটি নতুন তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য নির্দিষ্ট করা, অর্থাৎ নিউ কোম্পানি বোঝাতে ‘এন’ বর্ণটি বাছাই করা হয়। আর গ্রিনফিল্ড কোম্পানির জন্য ‘জি’ শ্রেণিটি নির্ধারণ করা হয়েছে ইংরেজি শব্দ গ্রিনফিল্ডের প্রথম বর্ণটি নিয়ে।
ফরহাদ আহমেদ আরও জানান, শেয়ারবাজারে ‘জেড’ শ্রেণিটির নামকরণ করেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) প্রয়াত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওয়ালি-উল-মারুফ মতিন। ইংরেজি বর্ণমালার সর্বশেষ বর্ণ ‘জেড’কে তিনি বেছে নেন শেয়ারবাজারের সবচেয়ে খারাপ কোম্পানিগুলোকে বোঝাতে। এভাবেই শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শ্রেণি ও তার নামকরণ হয়।
কোন শ্রেণিতে কত কোম্পানি
বর্তমানে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা ২২৯ ও ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি ৮২টি। ‘এন’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি রয়েছে ৪টি, ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি ৮২টি। এর বাইরে ‘জি’ শ্রেণিভুক্ত কোনো কোম্পানি বর্তমানে বাজারে নেই। দেশের শেয়ারবাজারে এখন পর্যন্ত একমাত্র গ্রিনফিল্ড বা ‘জি’ শ্রেণিভুক্ত কোম্পানি হিসেবে বাজারে এসেছিল লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট। বর্তমানে এটি একীভূত কোম্পানি হিসেবে লাফার্জহোলসিম সিমেন্ট হিসেবে লেনদেনে রয়েছে।
শ্রেণীকরণের আগে কী ছিল
দেশের শেয়ারবাজারে ইলেকট্রনিক বা ডিমেট শেয়ারের লেনদেন চালু হয় সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) হাত ধরে। এর পর থেকেই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার কেনাবেচা ও লেনদেন নিষ্পত্তি শুরু হয়, সেটি ২০০৪ সালের ঘটনা। সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, কাগুজে শেয়ার থেকে প্রথম ডিমেট শেয়ার হিসেবে লেনদেন শুরু করে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। তার আগে ১৯৯৮ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) অটোমেশন হয়। ডিএসইতে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লেনদেন চালু হলেও ডিমেট শেয়ার না থাকায় সে সময় ডিএসইতে কাগুজে শেয়ারেই লেনদেন হতো।
কাগুজে শেয়ার থাকা অবস্থা থেকেই শেয়ারবাজারে কোম্পানিগুলোর শ্রেণীকরণ ঘটে। মতিঝিলে ডিএসই ভবনে সংস্থাটির নিজস্ব ক্লিয়ারিং হাউসের মাধ্যমে শ্রেণি বিভক্ত কোম্পানিগুলোর লেনদেন হতো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে লেনদেন নিষ্পত্তিতে বেশি সময় লাগত সবচেয়ে খারাপ হিসেবে চিহ্নিত ‘জেড’ শ্রেণির ক্ষেত্রে। তখন ১০ দিনে এসব শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তি হতো।
শুরু থেকে জেড শ্রেণির শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তিতে বেশি সময় নির্ধারণ করা হয়, যাতে এ ধরনের শেয়ার কিনতে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হন। দীর্ঘ সময় কোনো শেয়ারে বিনিয়োগকারীর টাকা আটকে থাকলে তাঁরা এসব শেয়ার কেনায় বেশি আগ্রহী হবেন না, এমনটাই মনে করা হতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলামের মেয়াদকালে জেড শ্রেণির শেয়ারের লেনদেন নিষ্পত্তির সময় কমিয়ে দুই দিনে নামিয়ে আনা হয়। এটি করা হয়েছিল মূলত বাজারে লেনদেন বাড়ানোর জন্য, যাতে দীর্ঘদিন কোনো শেয়ারে বিনিয়োগকারীর টাকা আটকে না থাকে। এরপর তালিকাভুক্ত কোম্পানির শ্রেণীকরণের বিধান কয়েক দফা বদল করে শিবলী কমিশন। এর ফলে আধা শতাংশ লভ্যাংশ দিয়েও অনেক মানহীন কোম্পানি ‘বি’ শ্রেণিভুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। আবার জেড শ্রেণিতেও কোম্পানির সংখ্যা বেড়ে যায়। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে কোম্পানির শ্রেণীকরণের কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের।