বাজারকে স্বাভাবিক ধারায় ফেরাতে হলে নীতিসহায়তা দরকার।
মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের সিদ্ধান্ত এক বছর পেছানোর দাবি।
দেশের শেয়ারবাজার তিন বড় সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হলো— ভালো কোম্পানির ঘাটতি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সমস্যা হলো যথাক্রমে স্বচ্ছতার অভাব ও দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহির অভাব। এসব সমস্যার কারণে নতুন বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছেন না। যাঁরা বাজারে আছেন, তাঁদের মধ্যেও বাজার নিয়ে চরম আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। সমস্যাগুলোর সমাধান করা না গেলে দীর্ঘ মেয়াদে শেয়ারবাজার কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরে পাবে না।
বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এভাবেই শেয়ারবাজারে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ)। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার মতিঝিলে ডিএসই ভবনে ডিবিএ কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির বক্তব্য তুলে ধরেন সভাপতি সাইফুল ইসলাম। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ডিবিএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো. সাইফউদ্দিন, সহসভাপতি ওমর হায়দার খান, পরিচালক দস্তগীর মো. আদিল, মফিজউদ্দিন, সুমন দাশ প্রমুখ।
বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি বলছে, ভালো কোম্পানি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবে শেয়ারবাজার ধুঁকছে।
ডিবিএ বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই শেয়ারবাজার ধুঁকছে। এ অবস্থায় বাজারকে স্বাভাবিক ধারায় ফেরাতে হলে নীতিসহায়তা দরকার। তাই আমরা আশা করেছিলাম বাজেটে কিছু নীতিসহায়তা দেওয়া হবে। কিন্তু নীতিসহায়তার বদলে মূলধনি মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইনের ওপর নতুন করে করারোপ করা হয়েছে, যা বিনিয়োগকারীদের হতাশ করেছে।
এ বিষয়ে ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মূলধনি মুনাফার বিরুদ্ধে নই। কিন্তু বাজারের যে পরিস্থিতি, এখন মূলধনি মুনাফার ওপর করারোপের সময় নয়। তাই আমরা এ সিদ্ধান্ত এক বছরের জন্য পিছিয়ে দেওয়ার দাবি জানাই। পাশাপাশি কীভাবে সহজে মূলধনি মুনাফার ওপর থেকে কর কাটা হবে, তার একটি পথনকশা আশা করছি। বর্তমানে যে বিধান করা হয়েছে, তাতে উচ্চ সম্পদশালী বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে এই করহার গিয়ে দাঁড়াবে ৪১ শতাংশের বেশি। এত কর দিয়ে কোনো সম্পদশালী শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবেন না। এ ছাড়া মূলধনি লোকসান সমন্বয়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট ও কার্যকর ব্যাখ্যা দরকার। বাজেটে এ বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।’
শেয়ারবাজার যাতে তার স্বাভাবিক ধারা ফিরে পায়, সে জন্য বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি কিছু নীতিসহায়তা দরকার। কোনো বিনিয়োগকারী নতুন বিও (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স) হিসাব খুললে তাদের ক্ষেত্রে ১০ লাখ টাকার বিনিয়োগের শর্ত সাপেক্ষে তিন বছরের জন্য কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ডিবিএ। পাশাপাশি সংগঠনটি তাদের পুরোনো দাবিগুলোও নতুন করে পুনর্ব্যক্ত করেছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে ব্রোকারেজ হাউসের লেনদেনের ওপর থেকে উৎসে করা কমানো, তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর হারের ব্যবধান বৃদ্ধি, শেয়ারের বিপরীতে দেওয়া অনাদায়ি মার্জিন ঋণকে অনুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দেওয়া। এ ছাড়া সরকারি কোম্পানির শেয়ার তালিকাভুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে পথনকশা ঘোষণার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিম পর্যালোচনার দাবি
সম্প্রতি গণমাধ্যমে ডিএসইর এক স্বতন্ত্র পরিচালকের শেয়ার ব্যবসা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, স্টক এক্সচেঞ্জের পর্ষদে থাকা স্বতন্ত্র পরিচালকদের শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাইলে ডিবিএর পক্ষ থেকে বলা হয়, শেয়ারধারী পরিচালকেরা যেহেতু শেয়ার ব্যবসা করেন, তাই তাঁদের স্বার্থের সংঘাত রোধে স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন বা মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা করা হয়। বর্তমানে স্টক এক্সচেঞ্জে স্বতন্ত্র পরিচালকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকার বিষয়টি অনৈতিক। ডিএসইতেই যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে এবং তার জন্য ডিএসইর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে সেই বাজারে ভালো বিনিয়োগকারী আসবে না।
একই সঙ্গে সংস্থাটি বলছে, ডিমিউচুয়ালাইজেশনের ১০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আইনি ডিএসইকে যেসব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, বর্তমান পর্ষদ সেসব ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনার ভার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। অথচ ডিএসইর মতো প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জে শীর্ষ পদগুলো এক বছরের বেশি সময় ধরে শূন্য। স্টক এক্সচেঞ্জ ঠিকমতো চলছে কি না, এটিই এখন শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। তাই ডিবিএর পক্ষ থেকে ডিমিউচুয়ালাইজেশন কর্মসূচি বা স্কিম নতুন করে পর্যালোচনার দাবি জানানো হয়েছে।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আরেক সাংবাদিক শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কারও কারও জড়িত থাকার বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন। জবাবে ডিবিএ নেতারা বলেন, ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থার কেউ যদি শেয়ার ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, সেটি আমাদের জন্য অস্বস্তিকর বিষয়। এ ধরনের ঘটনা বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরায়।’
মার্জিন ঋণ সমস্যার সমাধান দাবি
ডিবিএ বলছে, ২০১০ সালের ধসের পর থেকে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করে রেখেছে শেয়ারের বিপরীতে বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের দেওয়া ঋণ। ধসের পর বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়ি থাকলেও বছরের পর বছর সেসব ঋণ স্থিতিপত্রে দেখানো হচ্ছে। এসব ঋণ আদৌ আদায় হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। দীর্ঘদিনের এ পুঞ্জীভূত সমস্যা সমাধানে নীতি সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি। তারা বলছে, এসব ঋণকে অনুমোদনযোগ্য খরচ হিসেবে দেখানোর সুযোগ দিয়ে এ সমস্যার স্থায়ী ও দ্রুত সমাধান দরকার।