হাজার কোটি টাকার লেনদেন, বাড়ল সূচকও

গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে ঢাকার শেয়ারবাজারে। পাশাপাশি হাতবদল হওয়া শেয়ারের সংখ্যাও ছিল ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বা ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার দ্বিতীয় দিনে শেয়ারবাজারে লেনদেন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সূচকও। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) গতকাল সোমবার দিন শেষে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৪২ কোটি টাকা। গত ছয় মাসের মধ্যে ডিএসইতে এটিই সর্বোচ্চ লেনদেন। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১৮ জুলাই ডিএসইতে ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।

শেয়ারবাজারের পতন ঠেকাতে ২০২২ সালের ২৮ জুলাই সর্বশেষ দফায় শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের সর্বনিম্ন দাম বা ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দিয়েছিল পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন বা বিএসইসি।

ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে বাজার কোথায় যাবে, এ রকম একটা ভীতি ছিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। গত দুদিনে সেই ভীতি অনেকটাই কমে গেছে।
শাকিল রিজভী, পরিচালক, ডিএসই

গত রোববার ৩৫টি কোম্পানি বাদে বাকি সব শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর থেকে বেঁধে দেওয়া এ দাম তুলে নেওয়া হয়। তাতে রোববার ডিএসইর প্রধান সূচকটি ৯৬ পয়েন্ট পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার দ্বিতীয় দিনে এসে সূচক ঘুরে দাঁড়ায়। ডিএসইএক্স সূচকটি গতকাল ১৪ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২৫৪ পয়েন্টে।

বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় বছর পর বাজারে শেয়ার কেনাবেচার স্বাভাবিক গতি ফিরে আসায় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় হতে শুরু করেছেন। তাতে বাজারে লেনদেনে গতি ফিরেছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক দিনের মধ্যে বাজার তার স্বাভাবিক শক্তিতে ঘুরে দাঁড়াবে।

ঢাকার বাজারে গতকাল ৩৯২ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের লেনদেন হয়। তার মধ্যে ২০৭টিরই দাম বেড়েছে, কমেছে ১৪৫টির। আর অপরিবর্তিত ছিল ৪০টির দাম। দীর্ঘদিন ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকার পর ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারও এখন মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় যুক্ত হয়েছে।

বাজার স্বাভাবিক গতি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মেজবাহ উদ্দিন আফফান ইউসুফ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্রোকারেজ

আরও ২৩ কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস মুক্ত

গতকাল আরও ২৩টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছে। তাতে এখন ফ্লোর প্রাইস আরোপ রয়েছে মাত্র ১২টি কোম্পানির ওপর। গতকাল যে ২৩টি কোম্পানির ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়, সেগুলো হলো বারাকা পাওয়ার, বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্‌ল, বিএসআরএম স্টিল, কনফিডেন্স সিমেন্ট, ডিবিএইচ, ডরিন পাওয়ার, এনভয় টেক্সটাইল, এইচআর টেক্সটাইল, আইডিএলসি, ইনডেক্স অ্যাগ্রো, কেডিএস এক্সেসরিজ, কাট্টলি টেক্সটাইল, মালেক স্পিনিং, ন্যাশনাল হাউজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল পলিমার, পদ্মা অয়েল, সায়হাম কটন, শাশা ডেনিমস, সোনালী পেপার, সোনার বাংলা ইনস্যুরেন্স, শাইনপুকুর সিরামিকস, সামিট পাওয়ার ও ইউনাইটেড পাওয়ার।

আর যে ১২ কোম্পানির ওপর এখনো ফ্লোর প্রাইস আরোপ রয়েছে, সেগুলো হলো আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি বা বিএটিবিসি, বেক্সিমকো লিমিটেড, বিএসআরএম লিমিটেড, গ্রামীণফোন, ইসলামী ব্যাংক, খুলনা পাওয়ার, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, ওরিয়ন ফার্মা, রেনাটা, রবি ও শাহজীবাজার পাওয়ার।

আসছে বিনিয়োগ

এদিকে গতকালও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেছে ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরাম। গতকাল সকাল ১১টায় অনলাইনে এ বৈঠক হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া ৩০ জন সিইও মিলে সিদ্ধান্ত নেন, আপাতত তাঁরা নিজস্ব পোর্টফোলিও বা পত্রকোষ থেকে বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করবেন না। বরং নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী শেয়ার কেনা অব্যাহত রাখবেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্রোকারেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন আফফান ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, বাজার তার স্বাভাবিক গতি ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউসগুলো বিনিয়োগ অব্যাহত রাখবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের ডিলার হিসাব থেকে আপাতত বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি না করার বিষয়েও একমত হয়েছেন বৈঠকে উপস্থিত সিইওরা।

শেয়ারবাজারের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীর সঙ্গে গতকাল কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁরা জানান, ফ্লোর প্রাইস উঠে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আবার বাজারমুখী হতে শুরু করেছেন। এত দিন যেসব বিনিয়োগকারী নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাঁরা সক্রিয় হচ্ছেন, তাঁরা নতুন করে বাজারে বিনিয়োগ করছেন। পাশাপাশি নতুন নতুন বিনিয়োগকারীও বাজারে যুক্ত হচ্ছেন। তবে নতুন বিনিয়োগকারীদের তুলনায় পুরোনো বিনিয়োগকারীরাই বেশি লগ্নি করছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী জানান, গতকাল তাঁর ব্রোকারেজ হাউসে নতুন-পুরোনো বিনিয়োগকারীরা মিলে প্রায় ১০ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন শেয়ারে বিনিয়োগের জন্য। এর মধ্যে পুরোনোরাই বেশি অর্থ জমা করছেন।

বাজারে যে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, তার প্রমাণ মেলে শেয়ার ও বিও (বেনিফিশারি ওনার্স) হিসাব সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্যেও। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ১৪ কার্যদিবসে নতুন করে শেয়ারবাজারে বিও হিসাব খুলেছেন প্রায় সাড়ে চার হাজার বিনিয়োগকারী।

বেড়েছে লেনদেন ও শেয়ারের হাতবদল

ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার পর প্রথম দিনে গত রোববার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছিল ৫৮৯ কোটি টাকা। আর গতকাল তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৪২ কোটি টাকায়। তাতে এক দিনের ব্যবধানে লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেয়ার কেনাবেচায় বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় লেনদেনেও তার ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

লেনদেন বৃদ্ধির ফলে বাজারে বেড়েছে হাতবদল হওয়া শেয়ারের সংখ্যাও। এক দিনের ব্যবধানেই এ সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। রোববার ঢাকার বাজারে ১৬ কোটি ২৮ লাখের বেশি শেয়ারের হাতবদল হয়েছিল। গতকাল সেটি বেড়ে ৩৩ কোটি ৭১ লাখ ৩৬ হাজারে উন্নীত হয়েছে। গতকাল হাতবদল হওয়া এ শেয়ারের সংখ্যা গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে সর্বশেষ গত বছরের ১০ জুলাই ৩৪ কোটি ৫৬ লাখ ১২ হাজারের বেশি শেয়ারের হাতবদল হয়েছিল।

শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে শেয়ারের ক্রয়াদেশ বাড়লে তাতে হাতবদল হওয়া শেয়ারের সংখ্যাও বেড়ে যায়। অর্থাৎ বাজারে যখন ক্রেতা বাড়ে, তখনই লেনদেন হওয়া শেয়ারের সংখ্যাও বাড়ে।

সার্বিক বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে বাজার কোথায় যাবে, এ রকম একটা ভীতি ছিল বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। গত দুদিনে সেই ভীতি অনেকটাই কমে গেছে। প্রথম দিন যে পরিমাণ বিক্রির চাপ ছিল, গতকাল সেই চাপ অনেকটাই কমে গেছে। বাজারে যখন শেয়ারের ক্রেতা থাকে, তখন বিক্রেতা কমে যায়। গত দুদিনে নতুন বিনিয়োগও আসছে। আশা করছি, কয়েক দিনের মধ্যেই বাজার তার নিজস্ব গতি ফিরে পাবে।’