গ্রাহকের অর্থ ও শেয়ারের প্রকৃত তথ্য আড়ালে ব্যবহার করা হয় বিশেষায়িত সফটওয়্যার।
২০২৩ সালে ডিএসই কিছু ব্যবস্থা নিলেও পরে তা প্রত্যাহার করে নেয় বিএসইসি।
ব্রোকারেজ হাউসটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে আসছিল বছরের পর বছর।
দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সদস্যভুক্ত ব্রোকারেজ হাউস মশিউর সিকিউরিটিজে রক্ষিত বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ারে বড় ধরনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। প্রতিষ্ঠানটি একাধিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের শেয়ার ও অর্থ মিথ্যা তথ্য দিয়ে আসছিল। আর মিথ্যা তথ্যের আড়ালে ব্রোকারেজ হাউসটি বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ার সরিয়ে নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ডিএসইর প্রাথমিক তদন্তে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ১৯ আগস্ট বিনিয়োগকারীদের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে প্রায় ৬৯ কোটি টাকার ঘাটতি পাওয়া গেছে। পাশাপাশি ব্রোকারেজ হাউসটিতে থাকা বিনিয়োগকারীদের শেয়ারেও বড় ধরনের ঘাটতি পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) হস্তক্ষেপ চেয়েছে ডিএসই কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ব্রোকারেজ হাউসটির মালিক ও শীর্ষ ব্যক্তিদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। পাশাপাশি গঠন করা হয়েছে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি। গত বৃহস্পতিবার বিএসইসির পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মশিউর সিকিউরিটিজের অনিয়ম তদন্তে বিএসইসি গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ এমদাদুল হক, সহকারী পরিচালক মারুফ হাসান ও অমিত কুমার সাহা; ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইকরাম হোসেন ও সিডিবিএলের উপব্যবস্থাপক শরীফ আলী ইরতেজা। তদন্ত কমিটিকে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও তাঁর ছেলে শেখ মোগল জান রহমান ও জিয়াউল হাসান চিশতীর দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে পুলিশের বিশেষ শাখা বা এসবিকে চিঠি দেওয়া হয়।
ডিএসই সূত্রে জানা যায়, ১৯ আগস্ট মশিউর সিকিউরিটিজে তদন্তে গিয়ে ডিএসইর প্রতিনিধিদল বেশ কিছু অনিয়ম খুঁজে পায়। প্রতিনিধিদলটি ১৯ আগস্টের পাশাপাশি ২০২২ সালের ১৩ জুন, ২০২৩ সালের ২৩ মে, ১৯ সেপ্টেম্বর ও চলতি বছরের ২ মে তারিখসহ গত কয়েক বছরের বেশ কয়েক দিনের সমন্বিত গ্রাহক হিসাবের তথ্য খতিয়ে দেখে। তাতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ১৩ জুন প্রতিষ্ঠানটির সমন্বিত গ্রাহক হিসাবে প্রায় ৮৬ কোটি টাকা, গত বছরের ২৩ মে ৭৭ কোটি, ১৯ সেপ্টেম্বর সাড়ে ৪ কোটি ও ২ মে তারিখে ৭৫ কোটি টাকা ঘাটতির তথ্য পায়।
এর আগে গত বছরের ২২ অক্টোবরও ব্রোকারেজ হাউসটিতে তদন্তে গিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পেয়েছিল ডিএসইর তদন্ত দল। এর ভিত্তিতে ওই বছরের ২৩ অক্টোবর থেকে প্রতিষ্ঠানটির লেনদেনের ক্ষেত্রে ফ্রি লিমিট সুবিধা, আইপিও কোটা সুবিধা বাতিলসহ আইন অনুযায়ী বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে ডিএসই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শিবলী রুবাইয়াত–উল–ইসলামের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএসইসি ব্রোকারেজ হাউসটির বিরুদ্ধে ডিএসইর নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রত্যাহার করা নেয়। এর বদলে সমন্বিত গ্রাহক হিসাবের ঘাটতি সমন্বয়ে দুই দফায় এক বছরের বেশি সময় দেওয়া হয়। এর মধ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ১৯ আগস্ট আবার ব্রোকারেজ হাউসটি তদন্তে গিয়ে গ্রাহক হিসাবে বড় ধরনের অনিয়ম এবং অর্থ ও শেয়ার ঘাটতির তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিএসই জানিয়েছে, মশিউর সিকিউরিটিজসহ ডিএসইর সদস্যভুক্ত আরও বেশ কিছু ব্রোকারেজ হাউস এএসএপি নামে একটি ব্যাকঅফিস সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। ব্রোকারেজ হাউসের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি বিশেষায়িত এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য কারসাজি বড় সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে ব্রোকারেজ হাউসটি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভুল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে আসছিল বছরের পর বছর। ফলে প্রতিষ্ঠানটিতে থাকা বিনিয়োগকারীদের অর্থ ও শেয়ারের গরমিলের বিষয়টি ধরা পড়ছিল না।
এ বিষয়ে জানতে মশিউর সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমানের মুঠোফোনে একাধিক যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল ধরেননি।
এদিকে ডিএসইর কাছ থেকে এসব তথ্য জানতে পেরে বিএসইসি ধারণা করছে, প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে গ্রাহকের বিপুল অর্থ ও শেয়ার আত্মসাতের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তাই ব্রোকারেজ হাউসটির বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তের পাশাপাশি মালিকদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর আগে গত কয়েক বছরে শেয়ারবাজারে বেশ কয়েকটি ব্রোকারেজ হাউসে বিনিয়োগকারীদের বড় অঙ্কের অর্থ ও শেয়ার আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় কয়েক প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগকারীরা কিছু ক্ষতিপূরণ পেলেও অনেকে এখনো অর্থ ফেরত পাননি।