দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় আড়াই মাসের মধ্যে শেয়ারবাজারে লেনদেন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে। প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আজ বুধবার লেনদেন নেমেছে ৩০০ কোটি টাকার নিচে। লেনদেনের পাশাপাশি ডিএসইএক্স সূচকটিও একই সময়ের ব্যবধানে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে।
ঢাকার বাজারে আজ দিন শেষে লেনদেনের পরিমাণ ছিল ২৯৬ কোটি টাকা। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর এটিই ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন। এর আগে সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট ডিএসইতে সর্বনিম্ন ২০৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। লেনদেনের পাশাপাশি ডিএসইর প্রধান সূচকটিও বুধবার ৫০ পয়েন্ট কমে নেমে এসেছে ৫ হাজার ৩১৬ পয়েন্টে। সরকার বদলের পর এটিও ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সর্বশেষ ৪ আগস্ট ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ২২৯ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল।
বাজার–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ারবাজারে গতি ফিরে এসেছিল। ওই সময় বেশ কিছুদিন বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ নেতৃত্বে শূন্যতা ছিল। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) পরিচালনা পর্ষদ ছিল অকার্যকর। তা সত্ত্বেও ডিএসইতে লেনদেন ছাড়িয়েছিল দুই হাজার কোটি টাকা। ডিএসইএক্স সূচকটিও মাত্র কয়েক দিনে ৮০০ পয়েন্টের বেশি বেড়ে ৬ হাজার পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়। এরপর বিএসইসি, ডিএসই ও সিএসই পুনর্গঠিত হয়। বাজারের কারসাজি রোধ ও নানা অনিয়মের ঘটনায় বিএসইসি ব্যবস্থা নিতে শুরু করার পর শুরু হয় দরপতন। সেই ধারা এখনো চলছে।
ঢাকার বাজারে আজ লেনদেন হওয়া ৩৯৫ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩০০টি বা ৭৬ শতাংশেরই দরপতন হয়েছে। দাম বেড়েছে ৫৩টির বা ১৩ শতাংশের আর অপরিবর্তিত ছিল ৪২টির বা ১১ শতাংশের দাম। দরপতনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল ব্যাংক খাতের। ডিএসইতে লেনদেন হওয়া ৩৬টি ব্যাংকের মধ্যে ২০টিরই দাম কমেছে গতকাল। আর মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৮টির, অপরিবর্তিত ছিল ৮টির দাম।
ব্রোকারেজ হাউস লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার বাজারে বুধবার সূচকের পতনের পেছনে যে পাঁচটি কোম্পানির সবচেয়ে বেশি ভূমিকা ছিল, তার মধ্যে দুটিই ব্যাংক। ব্যাংক দুটি হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক ও ব্র্যাক ব্যাংক। এই দুটি ব্যাংকের শেয়ারের দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি কমেছে প্রায় ১২ পয়েন্ট। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের ১ টাকা ২০ পয়সা বা ২ শতাংশ দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি সাড়ে ৮ পয়েন্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকের শেয়ারের ৮০ পয়সা বা দেড় শতাংশ দরপতনে সূচকটি সাড়ে ৩ পয়েন্ট কমেছে। এই দুই কোম্পানি ছাড়া সূচকের পতনে আরও যে তিন কোম্পানির ভূমিকা ছিল, সেগুলো হলো রেনাটা, বীকন ফার্মা ও বেক্সিমকো ফার্মা। এ তিন কোম্পানির দরপতনে ডিএসইএক্স সূচকটি ১১ পয়েন্টের বেশি কমেছে।
শীর্ষস্থানীয় একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগকারীই এখন লেনদেনে নিষ্ক্রিয়। তাঁদের একটি অংশ লোকসানের কারণে চুপচাপ বসে আছেন। আরেকটি অংশ যাঁদের বিনিয়োগের সক্ষমতা আছে, তাঁরা বিনিয়োগ না করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগও নেই বললেই চলে। শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বড় অংশই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আর্থিক সংকটে রয়েছে। এ অবস্থায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মতো সক্ষমতা ও বাস্তব অবস্থায় নেই এসব প্রতিষ্ঠান। আবার অতীতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগে আনা হতো সে রকম চেষ্টাও এখন নেই। এ কারণে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সব পর্যায়ের বিনিয়োগে কিছুটা ধীরগতি দেখা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বেসরকারি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য অনুষদের ডিন মোহাম্মদ মুসা বলেন, বাজারে দরপতন চলতে থাকায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা দিন দিন বাড়ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ আসে না, উল্টো বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরাও অনেক সময় লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান। অন্যদিকে শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তার বিপরীতে ব্যাংকে টাকা রেখে ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ পাওয়া যাচ্ছে। তাই বিনিয়োগকারীদের অনেকে শেয়ারবাজারের চেয়ে ব্যাংকে টাকা রাখাকে নিরাপদ মনে করছেন। তবে বাজারে গতি ফিরলে আবার নিষ্ক্রিয় বিনিয়োগকারীরা সক্রিয় হতে শুরু করবেন।