শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউসগুলোও সংকটে 

লেনদেন কমে যাওয়ায় অনেক ব্রোকারেজ হাউসের কমিশন কমে গেছে। বড় বড় ব্রোকারেজ হাউসও কয়েক মাস ধরে পরিচালন লোকসানে রয়েছে। 

দেশের শেয়ারবাজারে লেনদেনের মন্দাভাব বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এখন বিপাকে ফেলেছে। কয়েক মাস ধরে অনেক ব্রোকারেজ হাউসে কোনো লেনদেন নেই। আবার যারা লেনদেন করতে পারছে, তাতে তাদের তেমন মুনাফা হচ্ছে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান কয়েক মাস ধরে পরিচালন লোকসানে রয়েছে বলে জানা গেছে। 

গত কয়েক দিনে ছোট-বড় প্রায় ১০টি ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণগ্রস্ত সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অবস্থা বেশি খারাপ। শেয়ার লেনদেন করতে না পারলেও ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ গুনতে হচ্ছে তাঁদের। একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ব্রোকারেজ হাউস ঋণ দেয়, তারা কিছু সুদ পাচ্ছে। কিন্তু যারা ঋণ দেয় না, তাদের কয়েক মাস ধরে কোনো আয় নেই। কারণ, নিজেদের পোর্টফোলিওর পাশাপাশি সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লেনদেন কমে গেছে।

শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ কার্যদিবসে বাজারে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১ হাজার। 

যেসব ব্রোকারেজ হাউস ঋণে ব্যবসা করে না, তাদের আয় আসে শেয়ার লেনদেনের বিপরীতে পাওয়া কমিশন থেকে এবং পোর্টফোলিও বা নিজস্ব পত্রকোষের বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফা বাবদ। কিন্তু দুই মাসের বেশি সময় ধরে এ দুটি খাত থেকে ব্রোকারেজ হাউসগুলো তেমন আয় করতে পারছে না। কারণ, বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ এবং লেনদেন দুটোই তলানিতে নেমে গেছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ারই এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বেঁধে দেওয়া ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন দামে নেমে এসেছে। এসব শেয়ারের লেনদেন হচ্ছে না বললেই চলে। ফলে এসব শেয়ারে সাধারণ ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ আটকে আছে। 

দেশজুড়ে ২৩টি শাখা রয়েছে এমন একটি শীর্ষস্থানীয় ব্রোকারেজ হাউসের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনকভাবে পরিচালনা করতে হলে গড়ে প্রতিদিন সর্বনিম্ন ১০০ কোটি টাকার লেনদেন হওয়া দরকার। কিন্তু তখনই আমাদের লেনদেন শতকোটি টাকার বেশি হয়, যখন বাজারের সার্বিক লেনদেন ৭০০ কোটি টাকার ওপরে থাকে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৫০০ কোটি টাকার কম লেনদেন হচ্ছে। 

গতকাল রোববার ডিএসইতে লেনদেন নেমেছে ৩১৪ কোটি টাকা, যা গত ২০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত বছরের ৫ মে ডিএসইতে সর্বনিম্ন ২৩৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। লেনদেনের পাশাপাশি গতকাল সূচকও কমেছে। ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এদিন ২১ পয়েন্ট কমে ৬ হাজার ২২৫ পয়েন্টে নেমেছে।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী জানান, গত সেপ্টেম্বর থেকে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালন লোকসানে চলছে। তবে বছরের প্রথম ছয় মাসে ভালো ব্যবসা করায় গত কয়েক মাসের ধাক্কা সামাল দেওয়া গেছে। তিনি আরও জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ২৫০ কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন ৩০-৩৫ কোটি টাকা লোকসানে আছে।

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা ১০৫টি কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন হয়নি গতকাল। শতাধিক কোম্পানির শেয়ারের দাম এখন ফ্লোর প্রাইসে আটকে আছে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো কোম্পানির হাতেগোনা কিছু শেয়ার লেনদেন হয় ফ্লোর প্রাইসে। ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে গ্রামীণফোন, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসআরএম, স্কয়ার ফার্মার মতো ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিও রয়েছে। 

এই অবস্থায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, তারা এখনই ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে না। প্রতিষ্ঠানটি মনে করছে, এ মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস তুলে নিলে শেয়ারের দামে ধস নেমে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। 

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ফ্লোর প্রাইসের বিষয়টি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত। বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কমিশন এখনই এ বিষয়ে কিছু ভাবছে না। তবে এ কথা সত্য, তারল্য সংকটে বাজারে লেনদেন কমে গেছে। এ অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের সক্রিয় করে কীভাবে লেনদেন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যায়, তা নিয়ে কাজ করছে কমিশন। 

এদিকে শেয়ারবাজারে লেনদেন সেবা প্রদানের সনদ বা ট্রেক লাইসেন্স পাওয়া নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারেই বিনিয়োগকারী খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো লেনদেনও চালু করতে পারছে না। 

বাজারের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন, ফ্লোর প্রাইসের কারণে ব্যক্তিশ্রেণির ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সবারই কিছু অসুবিধা হচ্ছে এ কথা সত্য। তবে এ মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলেই যে বাজার ভালো হয়ে যাবে, সেটিও নয়। যেহেতু ব্লক মার্কেটে ফ্লোর প্রাইসের চেয়ে ১০ শতাংশ কম দামে শেয়ার কেনাবেচার সুযোগ রয়েছে, সেটিকে যে কেউ চাইলে কাজে লাগাতে পারেন।