এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক
এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক

এনআরবিসি ব্যাংকের ‘বাজেয়াপ্তযোগ্য’ শেয়ারও বিক্রি

  • কগত ৩১ অক্টোবর ব্যাংকটির উদ্যোক্তা এ বি এম আবদুল মান্নান প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার ৬৮ কোটি টাকায় বিক্রি করেন।

  • এসব শেয়ার কিনেছেন ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমালের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শফিকুল আলম, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমাম এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আহসানের মেয়ে রেহনুমা আহসান।

দেশের চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংকের এক উদ্যোক্তার ‘বাজেয়াপ্তযোগ্য ও বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার’ শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত এই উদ্যোক্তার শেয়ার বিক্রি এবং সুবিধাভোগীদের নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ অক্টোবর ব্যাংকটির উদ্যোক্তা এ বি এম আবদুল মান্নান তাঁর হাতে থাকা ৪ কোটি ৭০ লাখ শেয়ারের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। ওই দিনই ডিএসইর ব্লক মার্কেটে প্রতিটি ১৫ টাকা ২০ পয়সায় দরে সব শেয়ার বিক্রি হয়ে যায়।

ওই শেয়ারের মোট বিক্রয়মূল্য ছিল প্রায় ৬৮ কোটি টাকা। কিন্তু শেয়ারগুলো কারা কিনেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকটির একাধিক পরিচালকই বেনামে সব শেয়ার কিনে নিয়েছেন।

এম এ মান্নানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি শর্ত সাপেক্ষে লক-ইনের শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা এ শেয়ার কিনেছেন, তাঁদের শেয়ারের ওপর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত লক-ইনের শর্ত আরোপ থাকবে। বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারের স্বার্থে এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মোহাম্মদ রেজাউল করিম, মুখপাত্র, বিএসইসি

এ বি এম আবদুল মান্নানের নামে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে বলা হয়েছে, অত্যন্ত ‘সন্দেহজনক’ আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে আবদুল মান্নানের নামে শেয়ার কেনা হয়েছে। সে জন্য ওই সব শেয়ারকে ‘বাজেয়াপ্তযোগ্য’ বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়। কারণ, ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালে ওই ব্যক্তির নামে যে শেয়ার বরাদ্দ করা হয়, তার বিপরীতে তিনি কোনো অর্থ জমা করেননি। বরং তাঁর নামে অন্য এক ব্যক্তি অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। আবার বিনিয়োগের বিপরীতে প্রাপ্ত লভ্যাংশের অর্থও তাঁর অনুপস্থিতিতে দেশ থেকে তুলে নিয়েছেন অন্য ব্যক্তি। অর্থাৎ শুরু থেকেই এ বি এম আবদুল মান্নানের এসব শেয়ারের মালিকানা নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা ছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ারধারী আবদুল মান্নানের শেয়ারের সুবিধাভোগী ছিলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আহসান। এনআরবিসি ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকালে শহিদুল আহসান ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আবদুল মান্নানের নামে এসব শেয়ার কেনা হয়। আবদুল মান্নান যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক এবং পরিবারসহ সেখানেই বসবাস করেন। এনআরবিসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠালগ্নে দেশে তাঁর নামে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের গুলশান শাখায় দুটি হিসাব খোলা হয়। যদিও তিনি ওই সময় দেশে ছিলেন না। তাঁর একটি ব্যাংক হিসাবের পরিচয়দাতা ব্যক্তি ছিলেন শহিদুল আহসানের মালিকানাধীন আহসান গ্রুপের (এজি) এক কর্মকর্তা। ব্যাংক হিসাবটিতে জমা হওয়া অর্থও তুলে নেন ওই কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত অনুযায়ী, এনআরবিসি ব্যাংকের উদ্যোক্তা শেয়ার কেনার জন্য আবদুল মান্নানের ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে ৩৭ লাখ মার্কিন ডলার জমা হয়। এসব অর্থ জমা হয়েছিল দুবাই থেকে। ফলে ওই শেয়ারের প্রকৃত মালিকানা নিয়েও ছিল ধোঁয়াশা।

এনআরবিসি ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় ২০২১ সালের ২২ মার্চ। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নিয়ম অনুযায়ী, কোম্পানিটির উদ্যোক্তা–পরিচালকদের শেয়ারের ওপর তিন বছরের বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা বা লক–ইন রয়েছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির দিন থেকে নিষেধাজ্ঞার সময় গণনা শুরু হয়। সেই হিসাবে আবদুল মান্নানের শেয়ারের ওপর আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত বিক্রয় নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু বিক্রয় নিষেধাজ্ঞায় থাকা এসব শেয়ার বিএসইসির অনুমোদন নিয়ে সম্প্রতি ব্লক মার্কেটে হাতবদল হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এম এ মান্নানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি শর্ত সাপেক্ষে লক–ইনের শেয়ার বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁরা এ শেয়ার কিনেছেন, তাঁদের শেয়ারের ওপর নির্ধারিত সময় পর্যন্ত লক–ইনের শর্ত আরোপ থাকবে। বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারের স্বার্থে এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে এম এ মান্নান যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথম আলোকে জানান, তিনি অসুস্থ। তাই চিকিৎসার জন্য তাঁর অর্থের প্রয়োজন। এ জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন নিয়ে তিনি তাঁর নামের শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ সময় ব্যাংকটির শেয়ারে তাঁর বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ছোটখাটো একজন উদ্যোক্তা। অল্প কিছু টাকার শেয়ার বিক্রি করেছি। যাঁরা বড় বড় অনিয়ম করছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে আপনারা আমার বিষয়ে কেন এত খোঁজখবর করছেন?’

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, আবদুল মান্নানের বিক্রি করা ৪ কোটি ৪৯ লাখের বেশি শেয়ার কিনেছেন তিন ব্যক্তি। তাঁরা হলেন, এনআরবিসি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান এস এম পারভেজ তমালের ব্যবসায়িক অংশীদার ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি শফিকুল আলম, নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমাম এবং মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আহসানের মেয়ে রেহনুমা আহসান। এর মধ্যে শফিকুল আলম ১ কোটি ৬৫ লাখ, রেহনুমা আহসান ১ কোটি ৪৫ লাখ ও নাদিয়া মোমিন ইমাম ১ কোটি ৩৮ লাখের বেশি শেয়ার কিনেছেন।

এনআরবিসি ব্যাংকসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আবদুল মান্নান ব্লক মার্কেটের মাধ্যমে ৪ কোটি ৫০ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছেন, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। এর মধ্যে নাদিয়া মোমিন ইমাম ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ, শফিকুল আলম প্রায় দুই শতাংশ ও রেহনুমা আহসান পৌনে দুই শতাংশ শেয়ার কিনেছেন।

গত নভেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, এনআরবিসি ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের হাতে এখন ব্যাংকের প্রায় ১ কোটি ৯৪ লাখ শেয়ার রয়েছে, যা ব্যাংকের শেয়ারের ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর সঙ্গে তাঁর স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমামের শেয়ার যুক্ত হলে এই পরিবারের শেয়ার দাঁড়ায় প্রায় ৪ শতাংশ।

ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের হাতে আছে প্রায় পৌনে ৫ শতাংশ শেয়ার। এর সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার শফিকুল আলমের নামে থাকা প্রায় সোয়া দুই শতাংশ শেয়ার যুক্ত করলে ব্যাংকের মোট শেয়ারের ৭ শতাংশ রয়েছে এই দুজনের কাছে। পারভেজ তমাল, শফিকুল আলম, আদনান ইমাম ও তাঁর স্ত্রী নাদিয়া মোমিন ইমাম—এই চারজনের হাতেই রয়েছে ব্যাংকটির প্রায় ১১ শতাংশ শেয়ার।

সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে ব্যাংকের শেয়ার ক্রয়ে বাধা–নিষেধের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি, কোম্পানি বা একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ব্যাংকের শেয়ার কেন্দ্রীভূত করা যাবে না। আইনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, একক বা অন্যের সঙ্গে যৌথভাবে কোনো ব্যাংকের শতকরা ৫ ভাগের বেশি শেয়ার ধারণ করতে পারবে না।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ব্যাংকের মালিকানা যাতে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে চলে না যায়, সে জন্য ব্যাংক কোম্পানি আইনে এ বিধান যুক্ত করা হয়েছে। তারপরও দেখা যাচ্ছে, নামে–বেনামে কয়েকজন ব্যক্তির হাতেই এনআরবিসি ব্যাংকের মালিকানা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে। এর আগে নামে–বেনামে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে শেয়ার কিনে ব্যাংকটিতে বড় ধরনের ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল আহসান। এনআরবিসি ব্যাংকের পর্ষদে না থেকেও তিনি দীর্ঘদিন ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করেছেন বিভিন্ন ব্যক্তির নামে কেনা শেয়ারের মালিকানা থাকার জোরে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শহিদুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল মান্নানের কাছ থেকে আমার মেয়ের নামে কিছু শেয়ার কিনেছি। সেই শেয়ারে বিএসইসি লক–ইন আরোপ করেছে।’ বিদেশে থাকা আবদুল মান্নানের শেয়ার কীভাবে বিক্রি হলো, জানতে চাইলে শহিদুল আহসান বলেন, উনি দেশে এসে ওই শেয়ার বিক্রি করেছেন।

নানা অনিয়মের পর ২০১৭ সালে এই ব্যাংকের পর্ষদে পরিবর্তন আসে। তখন ব্যাংকটি পরিচালনার দায়িত্বে আসেন পারভেজ তমাল। পরে নামে–বেনামে ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত করেন তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার ও ঘনিষ্ঠজনদের। ব্যাংকটি এখন তাঁদের নিয়ন্ত্রণেই আছে। অর্থাৎ একটি গোষ্ঠীর হাত থেকে আরেকটি গোষ্ঠীর জিম্মায় গেছে এনআরবিসি ব্যাংক।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পারভেজ তমালের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।